মেঘনা থেকে বালু উত্তোলন, ভাঙনের মুখে জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা

‘আশুগঞ্জ বন্দর এলাকা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিকটবর্তী মেঘনা নদীতে দিন-রাত ড্রেজার বসিয়ে বেপরোয়া বালু তোলার ফলে নদীর তলদেশ ও তীর একসাথে ভেঙে পড়ছে, যা যেকোনো সময় ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।’

মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

Location :

Brahmanbaria
মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন
মেঘনা নদী থেকে বালু উত্তোলন |নয়া দিগন্ত

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে মেঘনা নদী থেকে বেপরোয়াভাবে বালু উত্তোলনের কারণে ভয়াবহ নদী ভাঙনসহ মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে আশুগঞ্জ নৌবন্দর এলাকা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাসহ তীরবর্তী এলাকা ভাঙনের মুখে পড়েছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, আশুগঞ্জ বন্দর এলাকা ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিকটবর্তী মেঘনা নদীতে দিন-রাত ড্রেজার বসিয়ে বেপরোয়া বালু তোলার ফলে নদীর তলদেশ ও তীর একসাথে ভেঙে পড়ছে, যা যেকোনো সময় ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।

জানা গেছে, গত ২০ আগস্ট ঢাকা-সিলেট করিডোর মহাসড়কের বালুর চাহিদার কথা বিবেচনা করে মহাসড়কের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিগো মীর আক্তারের প্রতিনিধি ‘এ-২ বি কর্পোরেশনকে তিন মাসের জন্য মেঘনা নদীর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছের এলাকা থেকে বালু তোলার অনুমতি দেয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে লাল নিশানা দিয়ে সীমানাও নির্ধারণ করে দেয়া হয়।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, বালু উত্তোলনকারীরা প্রশাসনের দেয়া লাল নিশান উঠিয়ে ফেলে বালু উত্তোলনের মহোৎসবে নেমে পড়ে। প্রতিদিন একসাথে ২০টিরও বেশি ড্রেজার মেশিন বসিয়ে নদী থেকে বালু তোলা হচ্ছে। নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে সরাসরি নদীর পাড়ে চলে আসা হচ্ছে। ফলে বন্দর এলাকাসহ, কৃষিজমি, বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

চরসোনারামপুর গ্রামে প্রায় পাঁচ হাজার জনগণের বসবাস। গ্রামটি এখন হুমকির মুখে। চরসোনারামপুরের পাশে নদীর পাড় দাঁড়িয়ে আছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ২৩০ কেভি বিদ্যুতের রিভার ক্রসিং টাওয়ার। বালু তোলার কারণে টাওয়ারের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অবস্থা চলতে থাকলে জাতীয় গ্রিড ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়বে।

স্থানীয় সামাজিক সংগঠনগুলো বলছে, এভাবে বালু তোলা চলতে থাকলে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড ও আশুগঞ্জ শিল্পাঞ্চল ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হবে। ইতোমধ্যেই চরাঞ্চলে ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করেছে।

তথ্যানুসন্ধ্যানে জানা যায়, বিগত ২০২২ সালে তৎকালীন ইউএনও এ বিষয়ে তার প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছিলেন চরসোনারামপুর ও আশপাশের এলাকা থেকে বালু উত্তোলন হলে আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানি লিমিটেড, আশুগঞ্জ বন্দর এলাকা, তীরবর্তী বাড়ি-ঘর ও কৃষিজমি নদী ভাঙনের শিকার হবে। একই মত প্রকাশ করেছিলেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক কার্যালয়ও। এরপরও সম্প্রতি জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অযুহাতে তিন মাসের জন্য বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এতে স্থানীয়দের মধ্যে দেখা দিয়েছে তীব্র উদ্বেগ ও ক্ষোভ।

আশুগঞ্জ জেনারেল মার্সেন্ট অ্যান্ড কমিশন অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো: জহিরুল ইসলাম জারু বলেন, ‘এ অবস্থা চলতে থাকলে তীরবর্তী এলাকা তো বটেই, আশুগঞ্জ বন্দরও ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়বে। আমরা ইজারা বাতিলের আবেদন করেছি, প্রয়োজনে আদালতের শরণাপন্ন হব।”

এ বিষয়ে আশুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাফে মোহাম্মদ ছড়া বলেন, মহাসড়কের ফোরলেন প্রকল্পের জন্য বালুর চাহিদা থাকায় তিন মাসের জন্য মীর আক্তারের প্রতিনিধিকে বালু উত্তোলনে অনুমতি দেয়া হয়েছে। সীমানা অতিক্রম কিংবা চুক্তি ভঙ্গ হলে আইনিব্যবস্থা নেয়া হবে।

অন্যদিকে মীর আক্তারের প্রতিনিধি কামাল আহমেদ জয় দাবি করেন, তারা ইজারার শর্ত মেনেই বালু উত্তোলন করছেন। তবে ভৈরবের একটি প্রভাবশালী মহল অবৈধভাবে ড্রেজার বসিয়ে বালু উত্তোলন করছে-যার দায় অন্যায়ভাবে তাদের ওপর চাপানো হচ্ছে।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, সরকারি দফতরের একাধিক প্রতিবেদনেই আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছিল এ এলাকায় বালু তুললে ভয়াবহ ক্ষতি হবে। তারপরও অব্যাহতভাবে বালু উত্তোলন চালানো হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, আশুগঞ্জের মেঘনা নদীভিত্তিক শিল্প ও বিদ্যুৎ স্থাপনা দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ নির্বিচারে বালু কাটার কারণে এই অঞ্চলকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। স্থানীয়দের দাবি, অবিলম্বে বালু উত্তোলন বন্ধ না হলে আশুগঞ্জে বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহাসড়ক, শিল্পাঞ্চল ও হাজারো মানুষের বসতি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাবে, যার প্রভাব পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতেও।