‘নৌকার গ্রাম’ ডহর রামসিদ্ধি, ২০০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন কারিগররা

একটি ১২ হাতের নৌকা চারজন কারিগর এক দিনেই তৈরি করেন। কারিগর খরচ পড়ে প্রায় চার হাজার টাকা।

ফরহাদ খান, নড়াইল

Location :

Narail
নড়াইলের হাটে নৌকা বিক্রি
নড়াইলের হাটে নৌকা বিক্রি |নয়া দিগন্ত

প্রাকৃতিক পরিবেশে গড়ে ওঠা নড়াইলের ডহর রামসিদ্ধি ‘নৌকার গ্রাম’ হিসেবে প্রসিদ্ধ। বংশ পরম্পরায় ২০০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে গ্রামবাসী। এখানে কমপক্ষে ৩০টি কারখানায় কারিগররা নৌকা তৈরি করেন। বর্ষাকালসহ প্রায় ছয় মাস ধরে নৌকা তৈরি ও বেচাকেনা চলে।

ঋতুচক্রে আশ্বিন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ শুরু হয়েছে। তবুও নড়াইলের ডহর রামসিদ্ধি গ্রামের নৌকা হাটটিতে চলছে জমজমাট বেচাকেনা। প্রতিদিন নতুন নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কারিগররা।

কারিগররা জানান, বাবা-দাদার হাত ধরে বংশ পরম্পরায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে ‘নৌকা তৈরির ঐতিহ্য’ ধরে রেখেছেন তারা। এখানে ছয় হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ টাকার নৌকাও তৈরি করা হয়। গ্রামটিতে প্রতি বুধবার নৌকার হাট বসে। ভোর থেকে শুরু করে সকাল ১০টা পর্যন্ত চলে বেচাকেনা। প্রতিহাটে গড়ে ১০০টি নৌকা বেচাকেনা হয়। তুলনামূলক কম দামে নৌকা কিনতে পেরে খুশি ক্রেতারাও।

হাড়িগড়া গ্রামের সাথীমনি জানান, বর্ষা বেশি হওয়ায় অন্যবারের চেয়ে এবার পানির চাপ বেড়েছে। তাই ঘরে বসে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যস্ত না থেকে মুক্ত আকাশে ঘুরে বেড়াতে ডহর রামসিদ্ধি হাট থেকে সাড়ে সাত হাজার টাকায় নৌকা কিনেছি। নৌকাটি শখের জন্য কেনা।

কালডাঙ্গা গ্রামের আমিনুল শেখ বলেন, রামসিদ্ধি হাট হওয়ায় আমাদের সুবিধা হয়েছে। এখানে সাত থেকে নয় হাজার টাকায় সাশ্রয়মূল্যে নৌকা কেনা যায়। এই নৌকা ধান কাটার পাশাপাশি মাছ ধরতে ব্যবহার করি। একটি নৌকা সাত থেকে আট বছর ভালোভাবে ব্যবহার করতে পারি।

মতিয়ার রহমান জানান, যে নৌকা বাড়ি গড়াতে (তৈরি) গেলে ১২ হাজার টাকা খরচ পড়বে, সেই নৌকা রামসিদ্ধি হাটে সাত থেকে আট হাজার টাকায় পাওয়া যাচ্ছে। কারণ এখানকার কারিগররা একসাথে অনেকগুলো নৌকা তৈরি করায় খরচ কম পড়ে। তাই কমমূল্যে কেনা যায়। আমাদের খাল-বিলে বর্ষার শুরু থেকে কার্তিক মাস পর্যন্ত নৌকার ব্যবহার করা যায়।

কালিয়ার কদমতলা গ্রামের মান্নান বলেন, ঘাস ও ধানকাটার জন্য নৌকা কিনতে এসেছি। এবার দাম একটু চড়া (বেশি) মনে হচ্ছে।

মাগুরার জয়নাল হোসেন ও আয়নাল হোসেন জানান, রামসিদ্ধি হাট থেকে আট হাজার ২০০ টাকায় তারা নৌকা কিনেছেন। ঘেরে মাছের খাবার দেয়ার জন্য নৌকাটি কিনেছেন তারা।

ডহর রামসিদ্ধি নৌকাহাট কমিটির সদস্য শান্তিরাম বিশ্বাস জানান, আষাঢ় ও শ্রাবণ দু’মাস বর্ষাকাল হলেও এখানে প্রায় ছয় মাস ধরে নৌকা বেচাকেনা চলে। নৌকা তৈরিতে মেহগনি, উড়িআম, রয়না ও পুয়ো বা পাউয়া কাঠ ব্যবহৃত হয়। একটি ১২ হাতের নৌকা চারজন কারিগর এক দিনেই তৈরি করেন। কারিগর খরচ পড়ে প্রায় চার হাজার টাকা। আর কাঠসহ অন্য খরচ তো আছেই। যেগুলো সাত থেকে দশ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। এছাড়া বড় নৌকা তৈরি করতে তিন থেকে চার দিন সময় লাগে।

তিনি আরো জানান, নড়াইলসহ মাগুরা, যশোর ও খুলনা এবং পাশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা রামসিদ্ধি হাটে নৌকা কিনতে আসেন। এ হাটকে ঘিরে অন্তত ৫০০ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। এখানে প্রতিটি কারখানায় তিন থেকে পাঁচজন কাজ করেন। প্রতি বুধবার ডহর রামসিদ্ধি নৌকাহাট থেকে ক্রেতারা ভ্যান, নসিমন, করিমন, পিকআপ, ট্রাকসহ বিভিন্ন যানবাহনে নৌকা নিয়ে যে যার গন্তব্যে চলে যান। তুলনামূলক কম দামে নৌকা কিনতে পেরে এই হাটে ক্রেতাদের ভিড় বেশি লক্ষ্য করা যায়।