আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মৃত্যুদণ্ডাদেশে খুশি জুলাই আন্দোলনে প্রথম শহীদ আবু সাঈদের পরিবার, তার সহযোদ্ধারা ও এলাকাবাসী। শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে দ্রুত রায় কার্যকরে উদ্যোগ নেয়ার দাবি তাদের। পাশাপাশি রায়ের পর শহীদ পরিবারগুলো নিরাপত্তাহীন বলেও দাবি করেছেন তারা।
রংপুরের পীরগঞ্জের বাবনপুর গ্রাম। সোমবার (১৭ নভেম্বর) সকাল থেকে মাটির ঘরের মেঝে ও উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছিলেন জুলাই বিপ্লবে প্রথম শহীদ আবু সাঈদের মা মনোয়ারা বেগম। বারবার আনমনা হচ্ছিলেন তিনি। অপরদিকে, আবু সাঈদের কবরের পাশে বসে আনমনে কী যেন ভাবছিলেন আবু সাইদের বাবা ও ভাইয়েরা। জুলাই বিপ্লবের প্রথম মামলার রায় হবে সেই ভাবনায় যেন ঘুরপাক খাচ্ছিল তাদের। রায় উপলক্ষে অনেক সহযোদ্ধা এবং এলাকাবাসীও ভিড় জমান কবরের পাশে।
বেলা ৩টায় রায় ঘোষণার সাথে সাথে প্রতিক্রিয়া জানান আবু সাঈদের বাবা-মা ও পরিবারের সদস্যরা। রায়ে সন্তুষ্ট হলেও কার্যকর করা নিয়ে উদ্বেগ আছে তাদের। চান বিদেশ থেকে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে রায় দ্রুত কার্যকর করা হোক। ছেলে হারানোর শূন্যতা দূর না হলেও স্বস্তি মিলবে তাদের।
শহীদ আবু সাইদের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘আমার সন্তান না থাকার যে শূন্যতা সেটা হয়তো পূরণ হবে না। কিন্তু খুনি শেখ হাসিনার ফাঁসির যে হুকুম হলো, তাতে আমি খুশি। শুনছি হাসিনা ভারত পালায়া গেছে। সেখান থেকে ফিরিয়ে এনে ফাঁসি কার্যকর করতে হবে। আমি যদি সেটা দেখে যেতে পারি। তাহলে আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে। যদি ফাঁসি কার্যকর করা না হয়, তাহলে আমার ছেলের আত্মা শান্তি পাবে না।’
শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন জানান, ‘এই শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের অন্য এমপি-মন্ত্রীরা যে শুধু আমার ছেলেকে খুন করেছে সেটা নয়, দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে তারা গুলি করে হত্যা করেছে। ১৭ বছরে হাজার হাজার মানুষ খুন, গুম করেছে। শুধু ফাঁসির রায় দিলে হবে না। আমি চাই দ্রুতগতিতে ভারত থেকে তাকে সরকার ফিরিয়ে আনুক এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করুক। তাহলে হাজার হাজার শহীদ পরিবারের কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে।’
রায়ে সন্তুষ্ট হলেও নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে এখন উদ্বিগ্ন আবু সাঈদের পরিবার। এখনো আওয়ামী লীগের লোকজন এবং দোসররা আশপাশে সক্রিয়। রায় হওয়ার কারণে তারা জুলাই শহীদ ও সম্মুখযোদ্ধাদের ওপর আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন বলে মনে করেন তারা।
শহীদ আবু সাঈদের বড় ভাই আবু হোসেন জানান, ‘আমরা কয়েক দিনে আওয়ামী লীগের তাণ্ডব দেখেছি। তারা বিভিন্ন স্থানে বাসে অগ্নিসংযোগ করেছে। বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ করেছে। তারা আগুন সন্ত্রাস থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। আমরা রায়ে সন্তুষ্ট। এই রায় হওয়ার সাথে সাথে আওয়ামী লীগের লোকজন শহীদ আহত এবং জুলাই যোদ্ধা পরিবারগুলোর প্রতি আরো ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তারা তাদের বাড়িঘরে হামলা চালাতে পারে। আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছি। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, শহীদ আহত জুলাই যোদ্ধাদের এবং তাদের পরিবারের প্রতি বিশেষ নজরদারী দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে।’
শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার বাদি তার বড় ভাই রমজান আলী জানান, ‘শুধু রায় ঘোষণা করলেই চলবে না। রায় কার্যকর করতে হবে। রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত আমরা এভাবে খুশি হতে পারব না। এজন্য কোনো ঢিলেমি আমরা মানবো না। এই রায় ঘোষণার পর আমাদের শহীদ আহত ও জুলাই যোদ্ধা পরিবারের সবাই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। কারণ এরই মধ্যে আওয়ামী লীগের লোকজন বিভিন্ন জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ, বিভিন্ন উপদেষ্টার বাসার সামনে নাশকতা তৈরি চেষ্টা করেছে। সংগত কারণে তারা শহীদ পরিবারগুলোর প্রতি খুবই ক্ষুব্ধ। আমরা চাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের ওপর বিশেষ নজর দিক। তা নাহলে তারা আমাদেরকে নানাভাবে আমাদের জীবন অনিরাপদ করে তুলবে।’
এদিকে, রায় ঘোষণার পর পীরগঞ্জের বাবনপুরে আবু সাঈদের কবরের পাশে মিষ্টি বিতরণ করেছে এলাকাবাসী।
এলাকাবাসী ও শহীদ আবু সাঈদের সহযোদ্ধা মাসুম বিল্লাহ জানান, ‘রায় ঘোষণার পরপরই আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসররা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। তাদের টার্গেট জুলাই যোদ্ধা, শহীদ ও আহত পরিবারগুলো। নিরাপত্তা নিশ্চিত করার না গেলে আওয়ামী লীগ গুপ্তভাবে সংগঠিত হয়ে বড় ধরনের অঘটন ঘটাতে পারে।’
এদিকে, রায় প্রকাশের পর সন্তোষ প্রকাশ করে আনন্দ মিছিল ও মিষ্টি বিতরণ হয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ মহানগরীর বিভিন্ন এলাকায়। তারাও সন্তোষ প্রকাশ করে দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন।
শহীদ আবু সাইদের সাথে আন্দোলনকারী রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক শামসুর রহমান সুমন জানান, ‘এই রায়ে আমরা তখন খুশি হব যখন হাসিনাকে ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে। যদি সেটা সরকার করতে ঢিলামি করেন তাহলে আবু সাঈদের সহযোদ্ধারা আমরা আবারো মাঠে নামতে বাধ্য হবো।’
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ডা: শওকত আলী জানান, ‘এটি একটি ঐতিহাসিক রায়। বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম রায়। আমরা চাই অবিলম্বে শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হোক।’
এই রায় কার্যকর করা না গেলে আবারো দেশ বড় ধরনের সংকটে পড়বে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।



