ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার প্রায় ২৫০ বছরের ঐতিহ্যবাহী আখের রস থেকে হাতে তৈরি মিহি দানার লাল চিনি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি পেয়েছে। বুধবার (২৭ আগস্ট) দুপুরে ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. আরিফুল ইসলাম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তিনি প্রত্যাশা করছেন, জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ায় আরো অনেক মানুষ এই চিনি উৎপাদনে আগ্রহী হবেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ জানান, ‘গত বছরের ১১ জুলাই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে লাল চিনির জিআই স্বীকৃতির জন্য আবেদন করা হয়। অন্য কোনো পক্ষের দাবি না থাকায় সব প্রক্রিয়া শেষে স্বীকৃতি পেয়েছি। সনদের জন্য গতকাল মঙ্গলবার সরকার নির্ধারিত ফি জমা দেয়া হয়েছে।’
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বাকতা, কালাদহ ও রাধাকানাই ইউনিয়নের প্রায় ২০টি গ্রামের কৃষকরা আখ উৎপাদন ও লাল চিনি তৈরির কাজ করেন। উপজেলায় প্রতিবছর শতকোটি টাকার লাল চিনি বিক্রি হয়। এ বছর উপজেলায় ৬৫০ হেক্টর জমিতে আখ চাষ হয়েছে। এক হেক্টর জমিতে উৎপাদিত আখ থেকে প্রায় আট মেট্রিক টন লাল চিনি উৎপাদন হয়। এ বছর প্রায় ১০৮ কোটি টাকার লাল চিনি বিক্রি করেছেন কৃষকরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জিআই স্বীকৃতির মাধ্যমে অর্থনীতিতে পরিবর্তন আসবে। কৃষকরা উৎপাদন বাড়াবেন। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতাও বাড়বে। অর্গানিক পণ্য হিসেবে দেশের বাইরে রফতানি করা গেলে চাষিদের জন্য নতুন সুযোগও তৈরি হবে।
স্থানীয় লোকজন ও কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কোনো ধরনের রাসায়নিক ছাড়াই হাতে তৈরি হয় এই লাল চিনি। চিনি উৎপাদনের প্রথম ধাপে আখ কেটে ইঞ্জিনচালিত মেশিনে মাড়াইয়ের মাধ্যমে রস সংগ্রহ করা হয়। এরপর চলে অন্যান্য কাজ। ড্রামে করে রস নিয়ে জ্বালঘরের ভেতরে আট থেকে ১০টি চুল্লিতে বড় লোহার কড়াইয়ে জ্বাল দিতে হয়।
কাঁচা রস ঘণ্টাখানেক জ্বাল দেয়ার পর তা ঘন হয়ে এলে কড়াই নামিয়ে কাঠের তৈরি ডাং (হাতল) দিয়ে গরম রসে দ্রুত ঘর্ষণ চালাতে হয়। ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে জমতে থাকে সেই রস। দ্রুত ঘর্ষণের ফলে একপর্যায়ে বালুকণার মতো হয়ে সেই রস লাল চিনিতে রূপ নেয়। প্রতি মণ গড়ে আট হাজার টাকায় বিক্রি হয় লাল চিনি।
ফুলবাড়িয়ার পলাশতলী চালাপাড়ার কৃষক এনামুল হক বলেন, ‘এই ঐতিহ্যবাহী চিনি জিআই মর্যাদা পাওয়ায় আমরা অত্যন্ত আনন্দিত।’
কৃষক দুলাল মিয়া জানান, বর্তমানে তারা লাল চিনির ভালো দাম পাচ্ছেন। ফুলবাড়িয়ার রাধাকানাই, পলাশতলী, বিদ্যানন্দ, কৈয়ৈরচালা, বাকতা, কুশমাইল, কালাদহ, এনায়েতপুর, রাঙামাটিয়া, সন্তোষপুর ও চৌধারসহ বিভিন্ন গ্রামে এই চিনি উৎপাদিত হয়।
প্রান্তিক কৃষকের জন্য লাল চিনি একটি নগদ অর্থকরী ফসল। এটি বাড়িতে কয়েক ধাপে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তৈরি করা হয়। সাধারণত এটি দুটি পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা হয়- ডিঙ্গি (বড় ট্রেতে) এবং ডাং বা দুপ (হাতে)।
রাধাকানাই গ্রামের কৃষক আরব আলী বলেন, ‘লাল চিনি জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় আমরা আখ চাষে আরো যত্নশীল হবো।’
উপজেলার বাকতা ইউনিয়নের বাকতা গ্রামের কৃষক জয়নাল মিয়া বলেন, ‘শুনছি আমাদের তৈরি লাল চিনির নাম একটা তালিকায় উঠছে। বেশিভাগ কৃষক দেশি জাতের আখ চাষ করে। ভালো জাতের আখ সবাই চাষ করলে ফলন আরো বাড়ত। আমরা যদি লাভবান হই, তাহলে আমরা আরো বেশি চাষাবাদ করতে উৎসাহ পাব।’
কালাদহ গ্রামের কৃষক সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘২০০ বছরের বেশি সময় ধরে আখের রস থেকে সনাতন পদ্ধতিতে বংশানুক্রমিকভাবে হাতে লাল চিনি তৈরি করছেন এই উপজেলার কৃষকরা। আমার বাপ-দাদারা আখ চাষ করে লাল চিনি উৎপাদন করতেন। এখন আমিও আখ থেকে চিনি উৎপাদন করি। এই চিনিতে কোনো ভেজাল নেই।’
ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক ড. নাসরিন আক্তার বানু জানান, ইতোমধ্যে কিছু কৃষককে প্রদর্শনী প্লটের আওতায় আনা হয়েছে এবং তাদের উন্নতমানের আখের জাত ও উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, দেশে একমাত্র ফুলবাড়িয়াতেই লাল চিনি উৎপাদিত হয় এবং এটি শিল্পে পরিণত হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।
যথাযথ পরিকল্পনা নেয়া হলে লাল চিনি রফতানিযোগ্য পণ্য হয়ে উঠতে পারে বলেও মনে করেন তিনি।