নরসিংদীর শিবপুরে সই জালিয়াতি করে শিবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয়ের টিআর-কাবিখা প্রকল্পের ৮১টি বিলের ৫২ লাখ ৭৮ হাজার ২৯০ টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে দুই কর্মচারীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনের বাড়ি থেকে ৫২ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
এ ঘটনায় মঙ্গলবার (১ জুলাই) শিবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো: জাহাঙ্গীর হোসেন শিবপুর মডেল থানায় মামলা করেছেন।
গ্রেফতাররা হলেন- শিবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কার্যালয়ের কার্যসহকারী আরিফুল ইসলাম তুহিন(৩৫) ও পিয়ন আশিক ভূঁইয়া(২৫)। আরিফুল ইসলাম ওরফে তুহিন শিবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কার্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হোসেন আলীর ছেলে। তারা স্বপরিবারে শিবপুর উপজেলা পরিষদের ভেতরে সরকারি কোয়ার্টারে থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি পাশের মনোহরদী উপজেলার চন্দন বাড়ি এলাকার। আশিক ভূঁইয়া শিবপুর উপজেলার মাছিমপুর ইউনিয়নের খড়িয়া গ্রামের জাকির হোসেনের ছেলে।
এ ঘটনায় সারা উপজেলায় তোলপাড় শুরু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এ ঘটনায় বড় বড় রাঘব বোয়ালরা জড়িত রয়েছেন। তাদের মধ্যে ইতিমধ্যে আতঙ্কও ছড়িয়ে পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে পিআইও অফিসে কার্যসহকারী তুহিন একক প্রভাব বিস্তার করে আসছেন। তুহিন এ অফিসে প্রথম পিয়নের কাজ করতেন। পরে তার বাবার এ উপজেলায় চাকরির সুবাদে পিআইও অফিস কার্যসহকারী (প্রকল্প) পদে ২০১৭ সনে শিবপুর অফিসেই যোগ দেন। সে থেকেই পিআইও অফিসের কর্তৃত্ব চলে যায় তার হাতে। কোনো পিআইওই তাকে ছাড়া কোনো কাজ করতে পারেন না। অফিসের সরকারি প্রকল্পের সকল বিল ভাউচার তুহিন তৈরি করেন এবং টাকা উত্তোলন করেন। প্রকল্পের সভাপতি / সেক্রেটারিদের তার কাছ থেকেই টাকা নিতে হয়।
পিআইও অফিসে চাকরি করে সে কোটিপতি বনে যায়। মামলার এজাহারে বলা হয়েছে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে টিআর-কাবিখার ৪৩০টি বিল পাস করে শিবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয়। এসব বিল উত্তোলন করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ব্যক্তিদের মধ্যে বিতরণ করার জন্য উপজেলা হিসাব রক্ষণ কার্যালয়ে পাঠানো হয়। কিন্তু উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে জানানো হয়, ৪৩০টি বিলের মধ্যে ৮১টি বিলের ৫২ লাখ ৭৮ হাজার ২৯০ টাকা আগেই উত্তোলন করা হয়ে গেছে। পরে সোনালী ব্যাংকের শিবপুর শাখার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনা করে উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট বিলের কপি ও ব্যাংকের পে-স্লিপ তলব করে একাধিক চিঠি পাঠান উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর হোসেন। কিন্তু এর কোনো জবাব না পেয়ে বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়। জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার জন্য দায়িত্ব দেয়া হয় ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টেলিজেন্সকে (এনএসআই)।
এনএসআইয়ের একটি দল তদন্ত করে দেখতে পায়, অর্থ আত্মসাতের সাথে আরিফুল ইসলাম তুহিন ও আশিক ভূইয়া জড়িত। এনএসআইয়ের ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস ও সোনালী ব্যাংক শিবপুর শাখার কয়েকজন কর্মকর্তার যোগসাজশে দুই কর্মচারী টিআর-কাবিখার ৮১টি বিলের ৫২ লাখ ৭৮ হাজার ২৯০ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
মঙ্গলবার (১ জুলাই) রাতে আরিফুল ইসলাম তুহিন ও আশিক ভুইয়াকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা দুজন অর্থ আত্মসাতের কথা স্বীকার করেন।
তারা বলেন, সরকারি দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় প্রতারণার মাধ্যমে উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস এবং সোনালী ব্যাংকের কয়েকজন অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায় স্বাক্ষর জাল করে গত ২৭ মে ও ৪ জুন ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়েছেন। পরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে তাদের থানায় আটক রাখা হয়। তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের স্বীকারোক্তি মোতাবেক মঙ্গলবার দুপুরে আরিফুল ইসলামের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ৫২ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়।
শিবপুর উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিসার মোহাম্মদ জুলকার নাইন বিল্লাহ জানান, পিআইও অফিস বিল দাখিল করেছেন। আমরা যাচাই করে সঠিকতা পেয়ে বিল পাশ করেছি। এখানে আমাদের অফিস থেকে কোন অনিয়ম করা হয়নি। এ বিষয়ে আমি থানায় জিডি করতে গিয়েছিলাম। থানা আমার জিডি নেয়নি।আমি নরসিংদী কোর্টে জিডি করেছি।
শিবপুর সোনালী ব্যাংক ম্যানেজার মো: সাইফুল ইসলাম জানান, শিবপুর ট্রেজারি অফিস আমাদের কাছে বিল পাঠিয়েছেন। আমরা বিল যাচাই করে সঠিকতা পেয়ে পিআইও অফিসকে টাকা প্রদান করেছি। এখানে আমাদের ব্যাংকের কোনো অনিয়ম হয়নি।
শিবপুর উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো: জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ৪৩০টি বিল ট্রেজারি অফিসে দাখিল করা হলে ৮১টি বিল বাউন্স করে দেয় অর্থাৎ ৮১টি বিল আগেই উত্তোলনের কথা বলা হয়। এ ব্যাপারে আমি থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করি। পরে শিবপুর মডেল থানা পুলিশ ও এনএসআই তদন্ত করে আমার অফিসের কার্যসহকারী (প্রকল্প) আরিফুল ইসলাম তুহিন ও পিয়ন(মাস্টার রোল) আশিক ভুইয়াকে ৫২ লাখ টাকাসহ আটক করে।তাদের কোর্টে পাঠানো হয়। মামলাটি পরবর্তী তদন্ত দুদক করবেন।
শিবপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: আফজাল হোসাইন বলেন, ‘এ ঘটনায় মঙ্গলবার উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। এটি মামলা হিসেবে রুজু করা হয়েছে। টাকাসহ দুজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের আদালতে পাঠানো হয়েছে। মামলাটি দুদক তদন্ত করে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেবেন।’
শিবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোছা: ফারজানা ইয়াসমিন জানান, বিষয়টি দুঃখজনক। টাকাসহ পিআইও অফিসের দুইজনকে আটক করা হয়েছে। এ বিষয়ে মামলা হয়েছে। দুদক তদন্ত করে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ঘটনার সাথে যারা জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।