জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আক্তার হোসেন বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে এমন পরিস্থিতি ছিল যে শিবির সন্দেহে কাউকে মেরে ফেললেও সেই বিষয়ে বিচার তো দূরের কথা, কথাও বলা যেত না।’
মঙ্গলবার (১১ নভেম্বর) রাত ১০টার দিকে কাউনিয়া উপজেলার ভায়ারহাট পিয়ারিয়া ফাজিল ডিগ্রি ফাজিল মাদরাসা মাঠে টেপামধুপুর ইউনিয়ন ৭ নম্বর ওয়ার্ড এনসিপি আয়োজিত মতবিনিময় সভায় একথা বলেন তিনি। এই মাদরাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে দাখিল পাশ করেন আখতার।
ভায়ারহাট পিয়ারিয়া ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসার সাবেক শিক্ষক সানাউল্লাহর সভাপতিত্বে সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন রাজারহাট বটতলা মাদরাসার সহকারী শিক্ষক আব্দুর রহমান, ভায়ারহাট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক প্রফুল্ল চন্দ্র বর্ম, শিক্ষক আইয়ুব আলী প্রমুখ।
আখতার হোসেন বলেন, ‘এই ভায়ার হাট মাদরাসায় আমি ক্লাস সিক্সে যখন ভর্তি হই, তখন রোল ছিল ৪১। পরে ১ রোল করে আমি সেভেনে উঠি। এইট, নাইন, টেন পর্যন্ত আমার ১ রোল থাকে। এই মাদরাসা থেকে আমি গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পাই। গোটা উপজেলার মধ্যে প্রথম হই। এরপর সাতগাড়া কামিল মাদরাসায় ভর্তি হই। সেখানেও আমার ১ রোল ছিল। গোল্ডেন জিপিএ পেয়ে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হই।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হওয়ার পর আমি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ি। রাজনীতি করার কারণে ছাত্রলীগ আমাকে চ্যাংদোলা করে হল থেকে নামিয়ে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দেয়। আমি আড়াই মাস ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বন্ধু-বান্ধবদের বাসা-বাড়ি ও মেসে থাকি। এরপর ঢাকা কলেজের হোস্টেলে উঠলে সেখানেও আমার উপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করে ছাত্রলীগ। সেখান থেকে আমি পালিয়ে শনির আখড়ায় গিয়ে উঠি। তবুও আমি আন্দোলন ছাড়িনি।’
এনসিপি সদস্য সচিব বলেন, ‘২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা যখন প্রশ্ন ফাঁস হয়। লাখ লাখ টাকা দিয়ে বড়লোকের সন্তানরা সেই প্রশ্ন কিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছিল। আমি যাকে প্রাইভেট পড়াতাম সেই শিক্ষার্থী আমাকে বলল, স্যার যদি প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় তাহলে আমার বাবার তো টাকা নেই, আমরা কী করব। টিউশনি থেকে বের হয়ে এসেই ক্যাম্পাসে সহকর্মী বন্ধুদের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি আন্দোলনের জন্য। কিন্তু কেউ আমাকে সাহস দিলো না। কারণ তার কিছুদিন আগেই আমাকে ক্যাম্পাস থেকে বের করে দিয়েছে ছাত্রলীগ। দু’-একজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলি। এরপর আমি একাই রাজু ভাস্করদের সামনে অনশনে বসি। প্রথমদিকে কেউ আমার অনশনের কথা শোনেনি। তিন দিনের মধ্যে আপামর ছাত্র-জনতা আমার সাথে সংহতি প্রকাশ করে আন্দোলনে নামে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেই ভর্তি পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয়। এখন পর্যন্ত আর কেউ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের খবর দিতে পারিনি। আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষের মাধ্যমে এত বড় অন্যায়ের বিলোপ হয়েছে জন্য মহান আল্লাহর কাছে শোকর প্রার্থনা করছি।’
আখতার বলেন, ‘বুয়েটে যখন আবরারকে ভারতের বিরুদ্ধে কথা বলার কারণে শিবির সন্দেহে হত্যা করা হলো। তখন আমি ভারত-বিরোধী আট স্তম্ভ নির্মাণ করলাম। পরের দিন সিটি করপোরেশনের বুলডোজার দিয়ে সেটি গুঁড়িয়ে দেয়া হলো। আমাকে গ্রেফতার করা হলো। থানায় নিয়ে যাওয়ার পর চোখ বেঁধে দেয়া হলো। হাত বেঁধে দেয়া হলো। আমাকে উল্টা করে বর্বর নির্যাতন করা হলো। এরপর আমি দু’সপ্তাহ হাঁটু গেড়ে সিজদা দিয়ে নামাজ পড়তে পারিনি। তারপরও আমি পিছপা হইনি। আমি মনে করেছি, আমার উপর নির্যাতনের মধ্য দিয়েই যদি সারা বাংলাদেশের মানুষ নির্যাতন মুক্ত হয়।’
তিনি বলেন, ‘এরপর আমি ডাকসুতে সমাজসেবা পদে নির্বাচন করি। সেই সময় ছাত্রলীগের বিপরীতে আমি বিপুল পরিমাণ ভোট পেয়ে সমাজসেবা সম্পাদক হই। কিন্তু আমাকে কোনো কাজ করতে দেয়া হতো না। আমার জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১২ লাখ টাকা। আমি একাই ছোট ছোট করে কাজ শুরু করলাম। ঘাস পরিষ্কার থেকে ছোট ছোট সকল কাজ। বছর শেষে সাড়ে চার লাখ টাকা আমার খরচ হলো। কোন খাতে কত টাকা খরচ হয়েছে সেই ম্যামোসহ আমি বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। কারণ আমি দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলাম অনিয়ম এবং দুর্নীতি যাতে না হয়।’
আখতার বলেন, ‘আওয়ামী লীগের আমলে শিবির সন্দেহে কাউকে মেরে ফেলা হলে বিচার তো হতোই না, এ বিষয়ে কথাও বলা যেত না। চব্বিশের জুলাই বিপ্লব আমরা প্রথমে নেপথ্যে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছিলাম। আবু সাঈদকে যখন এভাবে গুলি করে হত্যা করা হলো তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রকাশ্যে আসতে হবে। ১৭ জুলাই আমি টিএসসিতে গায়েবানা জানাজার ঘোষণা দিলাম। সেখানে আসা মাত্রই পুলিশ আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। আমাকে নিয়ে কাটাগারে ফাঁসির কাস্টের রুমে রাখা হলো। ৫ আগস্ট এর পর ৬ আগস্ট আমি মুক্তি পেলাম। আমাকে জেল সুপারের কাছে ডেকে নেয়া হলো। তখনও আমি দোদুল্যমান ছিলাম কী হবে আমার জীবনে। জেল সুপার যখন আমাকে বললেন, ভাই আপনি সোফায় বসেন। তখন আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। আমার মনে হলো বাংলাদেশ মুক্ত হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ছোটকালে পড়াশোনার সময় আমার স্বপ্ন ছিল একজন বক্তা হবো। কিন্তু আমি ঠিকই বক্তা হয়েছি, সেটি ওয়াজের বক্তা নয় রাজনীতির বক্তা। এখন আমার পেশা আইনজীবীতে আমি সেভাবে সময় দিতে পারি না। নির্বাচনের পর আমি আমার রুটি-রুজির পেশা আইনজীবীতে ফিরে যাব।’
আখতার বলেন, ‘গণতন্ত্রের জন্য অনেক দলের দরকার হলেও এলাকার জন্য একটি দলই যথেষ্ট। সব দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে এলাকার উন্নয়নে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। আমি যেভাবে ভাউচার দিয়ে ডাকসুর হিসাব দিয়েছি ঠিক তেমনিভাবে যদি এমপি নির্বাচিত হই, সরকারের সকল বরাদ্দের তথ্য উপজেলা এবং ইউনিয়নের কার্যালয়ে টাঙিয়ে দেবো। যাতে মানুষ বুঝতে পারে কোথায় কাজ হচ্ছে, কী কাজ হচ্ছে।’
তিন দিনের সফরে সোমবার(১০ নভেম্বর) সন্ধ্যায় রংপুর পৌঁছান আসেন আখতার হোসেন। পরে তার নির্বাচনী আসন রংপুর-৪ ঈদ আউলিয়া ও পীরগাছার বিভিন্ন এলাকায় মতবিনিময় সভা, উঠান বৈঠক, জনসংযোগ করেন। এসময় তিনি শাপলা কলি প্রতীকে ভোট প্রার্থনা করেন। মতবিনিময় সভায় বিপুল সংখ্যক নারী-পুরুষ অংশ নেন। বুধবার (১২ নভেম্বর) পীরগাছার বিভিন্ন এলাকায় গণসংযোগ করবেন তিনি এবং বৃহস্পতিবার (১৩ নভেম্বর) তিনি ঢাকা ফিরবেন বলে জানা গেছে।



