লালমনিরহাটে গত মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ আলু উৎপাদন হলেও কৃষকের মুখে এখন হাসির বদলে হতাশার ছাপ। উৎপাদন খরচের তুলনায় দাম কম পাওয়া এবং হিমাগারের ভাড়া বাড়ায় বড় ধরনের লোকসানে পড়েছেন তারা।
স্থানীয় কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, ২০২৪ সালে হিমাগারে ৭০–৮০ কেজির এক বস্তা আলু সংরক্ষণে ভাড়া ছিল ৩০০ টাকা। এ বছর হিমাগার মালিকরা ৬০ কেজির একটি বস্তার জন্য ৩৯০ টাকা ভাড়া নিচ্ছেন।
অন্যদিকে গত মৌসুমে প্রতি বস্তা আলুর উৎপাদন খরচ হয় ১,০৮০ থেকে ১,২০০ টাকা। তার সাথে হিমাগারের ভাড়া যোগ হলে এক বস্তায় মোট খরচ দাঁড়ায় ১,৪৭০ থেকে ১,৫৯০ টাকা।
তবে স্থানীয় বাজারে সেই আলুর বস্তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র ১,২০০ টাকায়। ফলে প্রতি বস্তায় কৃষকদের ২৭০ থেকে ৩৯০ টাকা পর্যন্ত লোকসান গুনতে হচ্ছে।
সাধারণত নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় থেকে বাজারে নতুন আলু আসতে শুরু করে। আর হিমাগার থেকে ৩০ নভেম্বরের মধ্যে সব পুরোনো আলু বের করা হয়। এরপর হিমাগারের রক্ষণাবেক্ষণ কাজ শেষ করে ফেব্রুয়ারির শেষ দিক থেকে নতুন মৌসুমের আলু সংরক্ষণ শুরু হয়।
কিন্তু এ বছর আলুর দাম কম থাকায় কৃষকেরা খুবই কম পরিমাণে আলু হিমাগার থেকে বের করছেন। অনেকে হিমাগারে যাওয়াও বন্ধ করে দিয়েছেন। তাতে নভেম্বরের মধ্যে সব আলু হিমাগার থেকে খালাস না হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এ ব্যাপারে একজন কৃষকের সাথে কথা বলতে চাইলে তিনি জানান, ‘এবার আলু আবাদ করবার যে খরচ বেশি হইছে। কিন্তু বাজারত আলুর দামে নাই। আবার স্টোরত ভাড়াও বেশি লাভ তো দূরের কথা আলু বেচেয়া এবার হামার খরচে উঠপার নয়। সরকার যদি এগুলা না দেখে হামাক আলু আবাদ বন্ধ করি দেয়া নাগবে।’
পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী ইউনিয়নের আলু চাষী কৃষক আবুল কাসেম বলেন, গত বছর ৫ বিঘা জমিতে আলু চাষ করেছিলেন তার পুর্বের বছর আলু চাষ করে কিছু লাভ হওয়ায় তিনি ঋণ করে আলু চাষ করেন কিন্তু দাম কম পাওয়ায় প্রায় ৭০ হাজার টাকা লস হয়েছে। লসের কারণে এবছর আলু চাষ করছেন না বলে তিনি জানান।
একই চিত্র কালীগঞ্জ উপজেলার আলু চাষীদের, উপজেলার ভোটমারী ইউনিয়নের কৃষক রবিন্দ্র চন্দ গত বছর ৫ একর জমিতে আলু চাষ করলেও এবছর করছে মাত্র ২ একর জমিতে।
লালমনিরহাটের এক হিমাগরে আলু রাখা কৃষক মোজাম্মেল হক বলেন, ভাল দামের আশায় ৫০ বস্তা আলু হিমাগারে রেখে ছিলেন কিন্তু দাম কম থাকায় খরচ পরিশোধ করে লস হওয়ার কারণে তিনি আলুর মালিকানার শর্ত ছেড়ে দিয়েছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত মৌসুমে লালমনিরহাটে ৭ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে কার্ডিনাল, ডায়মন্ড এবং বিলাতিসহ ৮–১০টি জাতের আলু চাষ হয়। মোট উৎপাদন হয় প্রায় ২ লাখ ৪ হাজার টন আলু, যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর মধ্যে প্রায় ৭৮ হাজার টন আলু সংরক্ষিত আছে জেলার নয়টি হিমাগারে।
কৃষক ও ব্যবসায়ীদের লোকসান ঠেকাতে আলুর ন্যূনতম মূল্য কেজি প্রতি ২২ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু স্থানীয় বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২০ টাকায়। এ অবস্থায় বড় ধরনের লোকসানের কারণে নতুন মৌসুমে আলু চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন কৃষক।
কৃষকের অভিযোগ, ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্তের পেছনে হিমাগার মালিকদের একচেটিয়া প্রভাবই মূল কারণ। হিমাগারে ভাড়া বাড়ার অজুহাতে বাজারে বিভিন্ন পর্যায়েও দাম বাড়ছে। কিন্তু এ বিষয়ে সরকারিভাবে কোনো মনিটরিং নেই। ফলে কৃষক বাধ্য হচ্ছেন লোকসান মেনে আলু বিক্রি করতে। হিমাগার ভাড়া নিয়ন্ত্রণ ও ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন চাষিরা।
ভোটমারী ইউনিয়ন উপ-সহকারী কৃষি অফিসার মো: ফরিদুল ইসলাম বলেন উপজেলার মধ্যে তার ইউনিয়ন বেশি আলু চাষ হয় কিন্তু এ বছর কৃষক লস করার কারণে ৩ ভাগের ১ ভাগ চাষ হচ্ছে।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো: শাইখুল ইসলাম বলেন, ‘আলুর দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৃষি বিভাগের কোন হাত নেই। আলুর দাম না পায় কৃষকরা এ বছর আলু চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। কৃষকদের জোর করে আলু চাষ না করিয়ে অন্য অর্থকারি ফসল চাষ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করছেন যাতে কৃষকরা কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেন।



