বাংলাদেশে ইলিশের প্রধান প্রজননকাল আশ্বিনী পূর্ণিমা ও অমাবস্যাকে কেন্দ্র করে। এ সময় মা ইলিশ ডিম ছাড়তে নদীমুখে আসে এবং সফল প্রজননের জন্য মাছ ধরা বন্ধ রাখা হয়। উপকূলীয় পটুয়াখালীর বিভিন্ন মৎস্য ঘাটে এখন সারি সারি ট্রলার নোঙর করে রাখা হয়েছে, জাল গুটিয়ে রাখা হয়েছে- কারণ চলছে নিষেধাজ্ঞা। মা ইলিশ যেন নির্বিঘ্নে ডিম ছাড়তে পারে, সে লক্ষ্যেই সাগর, নদী ও মোহনায় মাছ ধরায় বিরতি। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন হাজারো জেলে।
তবে স্থানীয় জেলেদের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। কারণ, একই বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকলেও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তা ১৩ দিন আগেই উঠে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ৪ অক্টোবর থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর, অথচ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে তা মাত্র ১১ দিন- ২ অক্টোবর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত।
জেলেদের আশঙ্কা, বাংলাদেশের জেলেরা যখন ঘাটে বসে থাকবেন, তখন ভারতের জেলেরা সাগরে মাছ ধরতে নামলে মা ইলিশের প্রজনন বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
ছোটবাইশদিয়া ইউনিয়নের গহিনখালী গ্রামের জেলে মজিবর প্যাদা বলেন, ‘আমাদের নিষেধাজ্ঞা শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই ভারতের জেলেরা সাগরে নামবে। তারা যেন আমাদের জলসীমায় ঢুকে মাছ না ধরে, সেটা নিশ্চিত করা জরুরি। তা না হলে আমরা কাঙ্ক্ষিত মাছ পাবো না।’
একই ইউনিয়নের কোড়ালিয়া গ্রামের ট্রলার মালিক মিথেল হাওলাদার বলেন, ‘আমরা নিষেধাজ্ঞা মানছি, ট্রলার ঘাটে বেঁধে রেখেছি। কিন্তু ওপাশে যদি মাছ ধরা শুরু হয়, তখন ইলিশ তো আর পাসপোর্ট-ভিসা নিয়ে সাঁতরে না! তখন ক্ষতি হবে আমাদেরই।’
তিনি আরো বলেন, ‘এই সময় নজরদারি না বাড়ালে নিষেধাজ্ঞার উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।’
স্থানীয় জেলেরা জানায়, সাধারণ সময়েও ভারত ও মিয়ানমারের জেলেরা বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকে মাছ ধরার নজির রয়েছে। তাই এই সময়ে কোস্টগার্ড ও নৌ-বাহিনীর কঠোর নজরদারির দাবি জানিয়েছেন তারা।
এ বিষয়ে পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. কামরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের জলসীমায় যদি কেউ না আসে, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। পাশের দেশ কী করলো, সেটা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। ৯০ ভাগ ইলিশই আমাদের অঞ্চলে ডিম ছাড়ে। আমাদের সাগর সীমানা পাহারা দেয়ার জন্য নৌ-বাহিনী ও কোস্টগার্ড রয়েছে। আমরা আশা করছি, ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা যথাযথ সময়েই হয়েছে। পাহারা সমুন্নত রাখতে পারলে ইলিশ নিরাপদে ডিম ছাড়বে এবং উৎপাদন বাড়বে।’
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই দেশের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা ভিন্ন হওয়ায় ইলিশ সংরক্ষণ কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ অ্যান্ড মেরিন সায়েন্স অনুষদের সহকারী অধ্যাপক ও গবেষক মীর মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘সাগর এক, ইলিশের প্রজাতিও এক- তাহলে নিষেধাজ্ঞা কেন এক নয়? আমাদের ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা বিজ্ঞানসম্মত, অথচ ভারতের তা মাত্র ১১ দিন। ইলিশ সংরক্ষণে নিষেধাজ্ঞার সঠিক প্রয়োগের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক সমন্বয় অপরিহার্য, যাতে এক দেশের শিথিলতা অন্য দেশের জেলেদের ক্ষতির কারণ না হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় গর্ব- অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও জীবিকার প্রতীক। কিন্তু এক বঙ্গোপসাগরে দুই দেশের ভিন্ন সময়ের নিষেধাজ্ঞা সংরক্ষণ অভিযানে প্রশ্ন তুলছে। আমাদের অবরোধের মাঝপথে ভারতের অবরোধ শেষ হলে তাদের জেলেরা আমাদের জলসীমায় মাছ ধরতে পারে, ফলে মা ইলিশ নদীমুখে ঢোকার আগেই ধরা পড়ার ঝুঁকি থাকবে। দুই দেশের নিষেধাজ্ঞা যদি একসঙ্গে হয়, তাহলে তা আরো কার্যকর হবে।’
উল্লেখ্য, চলতি বছর মাছের প্রজনন ও উৎপাদন বাড়াতে বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে মিল রেখে ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা কমিয়ে ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এতে উপকূলের জেলেরা সন্তুষ্ট ছিলেন। এখন ইলিশের প্রজনন মৌসুমেও সেই সমন্বয়ের দাবি তুলছেন তারা।