একসাথে ৭ বিয়ে করা কুষ্টিয়ার সেই রবিজুল মানব পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার

‘লিবিয়ায় ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আর্থিক প্রতারণা ও মানবপাচারের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে রবিজুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে।’

আ ফ ম নুরুল কাদের, কুষ্টিয়া

Location :

Kushtia
কুষ্টিয়ায় লিবিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য রবিজুল গ্রেফতার
কুষ্টিয়ায় লিবিয়ায় মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য রবিজুল গ্রেফতার |নয়া দিগন্ত

কুষ্টিয়ায় লিবিয়ায় আন্তঃজেলা মানব পাচারকারী চক্রের সদস্য রবিজুলকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

রোববার (২০ জুলাই) বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ইবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান।

গ্রেফতার রবিজুল কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ইবি থানার পাটিকাবাড়ি ইউনিয়নের পাটিকাবাড়ি গ্রামের মিয়াপাড়ার আয়নাল মণ্ডলের ছেলে।

জানা যায়, সাতজন নারীকে বিয়ে করা ও একসাথে ঘরসংসার করায় রবিজুল ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। তিনি ১৫ বছর লিবিয়াতে ছিলেন এবং মানবপাচার চক্রের সদস্য। কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। বিদেশে ভালো বেতনে চাকরির কথা বলে লিবিয়ায় পাঠিয়ে তাদের জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায় করার অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগ ও মামলার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ আজ রোববার বিকেলে তাকে বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছে।

স্থানীয়রা জানান, রবিজুলের প্রলোভনে পড়ে ভালো বেতনে চাকরির জন্য লিবিয়ায় যান কুষ্টিয়ার তানজির শেখ (২২)। এরপর সেখানে মানবপাচার চক্রের কাছে তাকে বিক্রি করে দেন রজিবুল। মানবপাচার চক্রের টর্চার সেলে দীর্ঘ নয় মাস বন্দি রাখা হয় তানজিরকে। সেখানে তাকে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। ঠিকমতো খেতে দেয়া হতো না, বেঁধে রাখা হতো, তিনবেলা লোহার রড ও লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হতো। বিবস্ত্র করে বেধড়ক মারপিটের ভিডিও পরিবারকে পাঠিয়ে মুক্তিপণ দাবি করা হতো। অবশেষে মুক্তিপণ নিয়ে তানজিরকে ছেড়ে দিয়েছে মানবপাচার চক্র। গত ৯ জুলাই দেশে ফিরেছেন তানজির শেখ। তানজির কুষ্টিয়া পৌরসভার ২০ নম্বর ওয়ার্ডের জগতী ষ্টেশন বাজার এলাকার সিরাজ শেখের ছেলে। আড়াই বছর আগে কুষ্টিয়ার রবিজুল দালালের মাধ্যমে ট্যুরিস্ট ভিসায় লিবিয়ায় গিয়েছিলেন তিনি।

ভুক্তভোগী পরিবারের কাছ থেকে দফায় দফায় ৩৪ লাখ টাকা নিয়েছে রবিজুল। সেসব টাকা ফেরত ও তার শাস্তি চায় ভুক্তভোগী পরিবার। রবিজুলের খপ্পরে পড়ে নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগী যুবক তানজিরের ওপর চালানো নির্মম, নৃশংস নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সাম্প্রতি মিডয়ায় সরগরম হলে রবিজুলকে আইনের আওতায় আনতে মাঠে নামে পুলিশ। ট্যুরিস্ট ভিসায় বিদেশে পাঠানোর মাধ্যমে মানবপাচার ও আর্থিক প্রতারণার অভিযোগে বেশ কয়েকটি মামলা রয়েছে রবিজুলের নামে।

তানজির শেখ সাংবাদিকদের জানান, রবিজুল লিবিয়াতে দীর্ঘ ১২ বছর ছিলেন। মাফিয়া চক্রের সাথে তার দালালের সুসম্পর্ক। তিনিও ওই চক্রের সদস্য। আমার বাবা তার মাধ্যমে আমাকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছিলেন। সেখানে যাওয়ার পর মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেন রবিজুল। মুক্তিপণের দাবিতে আমাকে তারা নয় মাস বন্দি করে রেখেছিল। বেঁধে রাখতো, তিনবেলা লোহার রড ও লাঠি দিয়ে বেধড়ক পেটানো হতো। নির্মমভাবে নির্যাতন, মারপিট করা হয়। কঠোর অত্যাচার করা হতো। খাবার দিতো না, তিনবেলা শুধু মারতো। মারতে মারতে শরীর ফাটিয়ে ফেলত। ক্ষত জায়গায় ইনফেকশন হয়ে পচে যেত। কোনো ওষুধ দিত সারাদিনে পাঁচ টাকা দামের একটা পাউরুটি ও অল্প একটু লবণাক্ত পানি খেতে দিত। লবণাক্ত পানি খাওয়ার কারণে শরীর আরো বেশি পচে যেত। না খাওয়ার কারণে শরীর একদম শুকিয়ে যায়। সব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে যায়। এজন্য মার খেতে খেতে অনেকে মরে যায়। মনে হতো আমিও মারা যাবো। রবিজুলের খপ্পরে পড়ে আমি মরতে বসেছিলাম। রবিজুল আমাদের কাছ থেকে ৩৪ লাখ টাকা নিয়েছে। আমি টাকা ফেরত চাই, একই সাথে তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তাকে দ্রুত গ্রেফতার করা হোক।

এই চক্র সম্পর্কে তানজির আরো বলেন, লিবিয়ার ওই মাফিয়া চক্রে ১৫-২০ জন সদস্য রয়েছে। তাদের মধ্যে ৫/৭ জন লিবিয়ার নাগরিক। প্রধান মাফিয়া লিবিয়ার আলী। উনি ওসামার ভাগ্নে বলে পরিচিত। মাফিয়া চক্রের সাথে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন যুক্ত আছেন। তাদের বাসা মাদারীপুর, সিলেট ও শরীয়তপুর। তাদের মধ্যে একজনের নাম পিচ্চি সোহেল, তার বাড়ি মাদারীপুর আর কুষ্টিয়ার রবিজুল।

তানজিরের বাবা সিরাজ শেখ বলেন, ভালো চাকরির প্রলোভন দিয়ে আমার ছেলেকে লিবিয়ায় পাঠায় রবিজুল। তার সাথে ১১ লাখ টাকার চুক্তি ছিল। প্রথমে পাঁচ লাখ টাকা দেই। এরপর আমার ছেলেকে লিবিয়ায় পাঠিয়ে দেন। এরপর বাকি ছয় লাখ টাকা পরিশোধ করি। এরপর ইতালি পাঠানোর কথা বলে আমার ছেলেকে মাফিয়া চক্রের কাছে বিক্রি করে দেন। ছেলে বন্দি থাকা অবস্থায় রবিজুল আরো ২৫ লাখ টাকা দাবি করেন। এর কিছুদিন পর রবিজুল বাড়ি থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে যান। এরপর নলখোলা গ্রামের আলামিন নামে একজন আমাদের সাথে যোগাযোগ করে এবং আমার ছেলেকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবে বলে প্রলোভন দেয়। তিনি ১৮ লাখ ৩০ হাজার টাকা নেন। এতে কোনো কাজই হয়নি। এরপরে মাফিয়াদের পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দিয়ে আমি আমার ছেলেকে ছাড়িয়ে এনেছি। তানজিরের মতো অসংখ্য মানুষের সাথে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেন রবিজুল। রবিজুল গ্রেফতার হয়েছে এমন খবর পেয়ে ইবি থানায় বেশ কয়েকটি ভুক্তভোগী পরিবার ছুটে এসেছে। তারা তাদের পাওনা টাকা ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছে।

ভুক্তভোগী ১২টি পরিবারের সদস্যরা জানান, রবিজুল ৬০ থেকে ৭০ জনের সাথে এমন প্রতারণা করেছেন। প্রতারণার শিকার প্রত্যেকের আত্মীয়স্বজন থানায় ভিড় জমাচ্ছেন। আরো অনেক ভুক্তভোগী আসছেন। প্রত্যেকে রবিজুলের কঠোর শাস্তি দাবি করে তাদের টাকা ফেরত পেতে চায়।

বিষয়টি নিশ্চিত করে ইবি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মেহেদী হাসান বলেন, ‘লিবিয়ায় ভালো বেতনে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে আর্থিক প্রতারণা ও মানবপাচারের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে রবিজুলকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। আর্থিক প্রতারণা ও মানবপাচারের অভিযোগে দেশের বিভিন্ন থানায় তার নামে মামলা রয়েছে। ইবি ও সদর থানায় ৫/৬টি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া আলমডাঙ্গা, কুমারখালীসহ বিভিন্ন থানায় মামলা রয়েছে। সব অভিযোগ আমরা তদন্ত করে দেখছি। তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’