মধু পুষ্টিকর প্রাকৃতিক সম্পদ এবং মানব দেহের বিভিন্ন রোগের মহাওষুধ। প্রথম বারের মতো পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া উপজেলায় তিল চাষ করে বিপ্লব ঘটিয়েছে স্থানীয় কৃষকরা। তিল উৎপাদন করে লাভবান হওয়ার আশা প্রকাশ করেছেন তারা।
এদিকে উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট জেলার পেশাদার মৌয়ালরা নিজ উদ্যোগে মধু চাষের উদ্যোগ নিয়েছে। পাঁচজনের একটি দল তিল ক্ষেত সংলগ্ন দক্ষিণ দিকে আসলাম নামের এক ব্যক্তির বাড়ির পাশের বাগানে এক শ’ ভাসমান মৌ চাক বসিয়ে মধু সংগ্রহ করছেন। ওই মৌ চাক থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছি তিল ক্ষেতে প্রবেশ করে ফুলে ফুলে ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন।
সরেজমিনে শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) বিকেলে উপজেলার পৈকখালী গ্রামে তিল ক্ষেত পরিদর্শনে দেখা গেছে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। যতদুর চোখ যায় ততদূরই শুধু তিল ক্ষেত।
এ সময় ক্ষেতে পরিচর্যার কাজ করছে কৃষক মো: আবুল হাওলাদার, মোবাক্কের হাওলাদার ও মো: শাহিন। তাদের সাথে আলাপকালে তারা জানায়, বেশ কয়েক বছর তারা পৃথকভাবে নিজেদের প্রয়োজনের জন্য কিছু জমিতে তিল চাষ করতেন। তাতে প্রতি বিঘায় (৬৩ শতাংশ) প্রায় খরচ বাদ দিয়ে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা লাভ হতো। এ বছর তাদের মেম্বরের পরামর্শে তারা স্থানীয় প্রায় ৫০ কৃষক একত্রিত হয়ে একটি প্রদর্শনী ব্লকের মাধ্যমে প্রায় ১০০ বিঘা জমিতে বারি-৪ জাতের তিল চাষ করেন। আর এতে প্রতি বিঘায় চাষ, সার, বীজ সব মিলিয়ে ২৩০০ থেকে ২৪০০ টাকা খরচ হয়েছে। এ বছর ফলন ভালো হয়েছে। সঠিকভাবে ফসল ঘরে তুলতে পাড়লে খরচ বাদ দিয়ে ১৫ থেকে ১৬ হাজার টাকা প্রতি বিঘায় লাভ হবে।
কৃষকরা জানায়, উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলে মাঘ-ফাল্গুন মাসে আমন ধান ওঠার পরই শুরু হয় কৃষকদের মৌসুমি সবজি চাষ। দক্ষিণের জনপদে এ মৌসুমে বাড়ির আঙিনা ছাড়াও মাঠে বেশিভাগই চাষ করা হতো চালকুমরা, মিষ্টি কুমরা, গোল আলু, মিষ্টি আলু, মরিচ, তরমুজ, বাঙ্গি (ফুট), চিনা বাদাম, মুসুরি, কলাই, মুগ ডাল, সূর্যমূখি, আখসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি। তিল চাষ ব্যপক আকারে হতো না। কিন্তু পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার পৈকখালীতে এ বছর বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়েছে তিল। তিল থেকে মধু আহরণসহ ভোজ্য তৈল, খৈল উৎপাদন করা হয়। খৈল গবাদি পশুর পুষ্টি বাড়াতে খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি বিভিন্ন গাছের জন্যও ব্যবহার করা হয়। তিলের কাঁচা গাছ গো খাদ্য ছাড়াও শুকনা গাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
তারা আরো জানায়, তিল চাষাবাদে খরচও কম। শুকনো মৌসুমে মাঠে শুধু একবার চাষ করে বিচি ফেলার পর বাড়তি কোনো পরিচর্যার প্রয়োজন পরে না। দেড় থেকে দুই মাসের মধ্যে এ ফসল তোলা যায়। তাই উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে এডিপির-এর আওতায় দুই লাখ টাকা ব্যায়ে এ প্রদর্শনী ক্ষেত করা হয়। বাস্তবায়িত ফসলের নাম দেয়া হয়েছে তৈল জাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি বারি-৪ জাতের তিল চাষ প্রদর্শনী।
এদিকে বড় তিল ক্ষেতের খবর শুনে উপকূলীয় দক্ষিণাঞ্চলের বাগেরহাট জেলার কিছু পেশাদার মৌয়াল নিজ উদ্যোগে মধু চাষের উদ্যোগ নিয়েছে। পাঁচজনের একটি দল তিল ক্ষেত সংলগ্ন দক্ষিণ দিকে জনৈক সুইডেন আসলাম নামের এক ব্যক্তির বাড়ির পাশের বাগানে এক শ’ ভাসমান মৌ চাক বসিয়েছে। তাতে থাকা মৌমাছি তিল ক্ষেত থেকে মধু আহরণ করে চাকে সংগ্রহ করে। যা নির্ধারিত সময়ে ভাঙা হবে।
মৌয়াল মো: ফরুক এবং রানার সাথে আলাপ করে জানা গেছে, তারা দেশের বিভিন্ন স্থানে মৌসুমে ঘুরে ঘুরে এভাবে নিজ উদ্যোগে মধু সংগ্রহ করেন। তাদের সমস্ত খরচ বাদ দিয়ে বেশ ভালো লাভ থাকে। মধু সংগ্রহের পর সঠিকভাবে বোঝা যাবে কত? লাভ হলো।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্য মো: জিয়া উদ্দিন জানান, ‘আগে আমরা উপজেলা কৃষি অফিস থেকে যে কৃষি প্রনোদোনা দেয়া হতো তার সঠিক ব্যবহার হতো না। তাই এ বছর আমি নিজ উদ্যোগে স্থানীয় সকল কৃষকদের সাথে আলাপ করে আগ্রহীদের নিয়ে এ ব্লকটি তৈরী করি। ফসল যা ফলেছে তাতে আশা করছি, ভালো লাভ হবে এবং এ বছর তিল চাষে এলাকায় একটা বিপ্লব ঘটেছে। তিলের পাশাপাশি এ বছর সূর্যমূখির ফলনও ভালো হয়েছে। আগামীতে পুরো মাঠ ছাড়াও (মাঠে প্রায় দুই শ’ বিঘা জমি আছে) পাশের ৫০ বিঘা যোগ করে তিল ও তরমুজ চাষ করব।
এ ব্লকের তদারকিতে থাকা উপজেলা উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো: ইখতে খাইরুল আলম মোবাইল ফোনে জানান, উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এবং উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের বাস্তবায়নে, স্থানীয় কৃষকদের ৪৫ থেকে ৫০ জনের একটি কৃষকের দল করে এ প্রদর্শনী ব্লকটি করা হয়েছে। এখানের কৃষকরা চাষাবাদে যেভাবে আগ্রহী, সেভাবে যদি সব এলাকার-অঞ্চচলের কৃষকরা আগ্রহী হয়, তাহলে কৃষিতে ব্যাপক বিপ্লব ঘটানো সম্ভব হতো। তাহলে আমাদের দেশে তৈল ও মধু মজুত করে বিদেশে বেশি দামে রফতানি করা যেত।