রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চাকরি হারিয়ে হাজারো বাংলাদেশী যুবকের সড়ক অবরোধ

‘তারা এখন অনলাইন গেমিং, টিকটকে সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার মাদক ও মানবপাচারের দিকেও ঝুঁকছেন—যা গোটা সমাজের জন্য ভয়াবহ ইঙ্গিত। স্থানীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিক চাকরি সংরক্ষণ আইন পাস করা।’

হুমায়ুন কবির জুশান, উখিয়া (কক্সবাজার)

Location :

Ukhia
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চাকরি হারিয়ে হাজারো বাংলাদেশী যুবকের সড়ক অবরোধ
রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চাকরি হারিয়ে হাজারো বাংলাদেশী যুবকের সড়ক অবরোধ |নয়া দিগন্ত

‘রোহিঙ্গাদের পড়াতে গিয়ে নিজের জীবনটাই হারিয়ে ফেলেছি’ বললেন উখিয়ার শামিরা আক্তার। আট বছর ধরে একটি এনজিও স্কুলে শিক্ষকতা করে আসা শামিরা এখন বেকার। শুধু তিনিই নন, তার মতো উখিয়া-টেকনাফের প্রায় ১,২৫০ জন স্থানীয় শিক্ষক একযোগে চাকরি হারিয়েছেন রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য পরিচালিত এনজিও স্কুল থেকে।

ঈদুল আজহার ঠিক আগে এসব শিক্ষক ছাঁটাই করা হয়, কারণ হিসেবে দেখানো হয় তহবিল সংকট। তবে বিতর্ক শুরু হয় তখনই, যখন দেখা যায়, রোহিঙ্গা শিক্ষকদের বহাল রেখে স্থানীয়দের বাদ দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতির প্রতিবাদে স্থানীয় শিক্ষকরা কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক অবরোধ করেন।

আন্দোলনের মুখে ইউনিসেফ ক্যাম্পে শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়। ঈদের ছুটির পরও স্থানীয়দের ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। কয়েকটি এনজিও অফিসে গিয়ে শিক্ষকরা উত্তেজিতভাবে শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় চালু না করার দাবি তোলেন। এতে অনেক এনজিও অফিস বন্ধ হয়ে যায়। অফিস ভবনের মালিকদের সাথেও বাকবিতণ্ডা হয়, যা সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। একটা প্রজন্ম দাঁড়িয়ে আছে অনিশ্চয়তার মুখে। উখিয়া-টেকনাফে কোনো শিল্প কারখানা নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও সীমিত। ফলে এনজিও চাকরিই ছিল এখানকার শিক্ষিত যুবকদের প্রধান ভরসা। বর্তমানে দুই উপজেলার প্রায় ৭০–৮০ হাজার শিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকার। যাদের মধ্যে একটি বড় অংশ ২০১৭ সালের পর রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এনজিওতে যুক্ত হয়েছিল।

উল্লেখ্য, এই কর্মসংস্থানের সুযোগ ২০১৭ সালে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিলে তৈরি হয়। শুধু এনজিওর মাধ্যমেই নয়, স্থানীয় হোটেল, মার্কেট, পরিবহন, নির্মাণ ও ভাড়া দেয়া ঘরের মালিকরাও রোজগার করতে থাকেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দাতাদের অনুদান কমে গেলে অনেক প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়, বন্ধ হয় স্বাস্থ্যকেন্দ্র, স্কুল, সুরক্ষা প্রোগ্রাম। ধীরে ধীরে হাজারো কর্মী ছাঁটাই হয়ে যায়। রাজনীতি ও সামর্থ্য থাকলেও নীরব ধনীরা- উখিয়া-টেকনাফে ২০২৪ সালের স্থানীয় নির্বাচন, ২০২৩ সালের সংসদ নির্বাচন ঘিরে প্রচুর রাজনৈতিক তৎপরতা দেখা গেলেও, এলাকার অর্থনৈতিক বিকাশে কোনও বাস্তব উদ্যোগ চোখে পড়েনি। অথচ এই অঞ্চলে গড়ে উঠেছে অনেক কোটিপতি, অনেকে এনজিও, জমি ব্যবসা কিংবা রাজনীতিকে পুঁজি করে বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন। প্রশ্ন হলো, এই কোটিপতিরা কি চাইলেই একটি ছোট শিল্প কারখানা স্থাপন করতে পারেন না? শুধু একটি গার্মেন্টস কারখানা চালু হলে অন্তত ৫০০ থেকে ১০০০ জন যুবতী কর্মসংস্থান পেতেন।

একটি পর্যটন কেন্দ্র চালু হলে স্থানীয় ২০০০-৩০০০ জন যুক্ত হতে পারতেন হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পরিবহন ও ট্যুর গাইড হিসেবে। মাছ/মুরগি/হস্তশিল্প প্রক্রিয়াজাতকরণ ফ্যাক্টরি হলে নারী উদ্যোক্তারাও ঘরে বসে রোজগার করতে পারতেন।

রাজনীতিবিদদের মধ্যে কেউ কেউ উচ্চস্বরে উন্নয়নের কথা বললেও, বাস্তবে স্থানীয় বেকারদের জন্য কোনো কাঠামোগত কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি। স্বপ্ন দেখিয়েছিল রোহিঙ্গারা, শেষ করে দিল তারাই’ কফুরুন্নেছা বলেন, ‘স্বামী নেই, বাবাও নেই। আমি একাই ছেলেমেয়েকে মানুষ করছি। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চাকরিটা ছিল একমাত্র ভরসা। ১৫ হাজার টাকা বেতনে সংসার চলতো। এখন একেবারে থেমে গেছি। শুধু তিনি নন, বেকারদের মধ্যে অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন।’

কয়েকজন তরুণ জানান, তারা এখন অনলাইন গেমিং, টিকটকে সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ আবার মাদক ও মানবপাচারের দিকেও ঝুঁকছেন—যা গোটা সমাজের জন্য ভয়াবহ ইঙ্গিত। স্থানীয়দের অগ্রাধিকার ভিত্তিক চাকরি সংরক্ষণ আইন পাস করা। ক্ষুদ্র শিল্প পার্ক নির্মাণ–গার্মেন্টস, কৃষিভিত্তিক কারখানা, হস্তশিল্প, উদ্যোক্তা উন্নয়ন তহবিল চালু – যাতে তরুণরা ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করতে পারে। মনোসামাজিক কাউন্সেলিং ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র – হতাশা ও নেশা থেকে মুক্ত রাখতে জেলা প্রশাসনের অধীনে স্থানীয় কর্মসংস্থান পরিকল্পনা গ্রহণ, এক সময় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল উখিয়া-টেকনাফবাসী। এখন সময় হয়েছে তাদের নিজ সন্তানদের জন্য দাঁড়ানোর। স্থানীয় রাজনীতিবিদ, কোটিপতি, প্রশাসন ও এনজিও সমন্বিতভাবে একটি স্বপ্নময় ভবিষ্যৎ গড়তে উদ্যোগ নিলে এই হতাশাকে রূপ দেয়া যাবে সম্ভাবনায়।