মুরাদনগরে নারীদের হাতে তৈরি দোলনা শিল্পে বিপ্লব

সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পেলে এ হস্তশিল্পটি বহুদূর এগিয়ে যাবে।

নাজিম উদ্দিন, মুরাদনগর (কুমিল্লা)

Location :

Cumilla
রঙিন দোলনা।
রঙিন দোলনা। |নয়া দিগন্ত

কুমিল্লা মুরাদনগরে শুরুটা ৩০ বছর আগে। মাত্র দু’চারটি পরিবার থেকে এখন বিস্তৃত পাঁচ হাজার পরিবারে। পরিবারের কাজের পাশাপাশি গ্রামের ৯০ শতাংশ নারী হাতে বুনে তৈরি করেছেন রঙিন সুতার দোলনা। নারীদের এমন শিল্প বিপ্লব এবং আয়-রোজগার দেখে লোভ সামলাতে পারেননি কয়েক গ্রামের পুরুষরা। তাই তারাও বেছে নিয়েছেন দোলনা তৈরির পেশা। যুগের পর যুগ হাজার পরিবারের যেন একমাত্র আয়ের উৎস বাঁশ-বেত ও সুতোর তৈরি এ দোলনা।

উপজেলার বাবুটিপাড়া ইউনিয়নের দৈয়ারার চিত্র এটি। গ্রামটি এখন দোলনার গ্রাম হিসেবে পরিচিত। দৈয়ারা গ্রামের নারীদের দোলনা শিল্প এখন এলাকার দৃষ্টান্ত। এদিকে রঙিন সুতোয় দোলনা তৈরি করে নিজেদের ভাগ্য বদল করে নিচ্ছেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও চাহিদা অনুযায়ী ঋণ পেলে চমক সৃষ্টি করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এ পেশায় থাকা সংশ্লিষ্টরা।

জানা গেছে, দৈয়ারা গ্রামে ৩০বছর আগে দোলনা তৈরি শুরু করে একটি পরিবার। বর্তমানে ওই গ্রামের আশপাশের গ্রাম গান্দ্রা, তেলুয়া মাইনকা, বাবুটিপাড়া ও পাহাড়পুরসহ পাঁচটি গ্রামের অত্যন্ত পাঁচ হাজার পরিবার এ দোলনা তৈরির কাজে জড়িয়ে পড়েছেন। দোলনা তৈরি করতে সুতা উৎপাদন ও সুতায় বিভিন্ন রকমের রং করার জন্য গড়ে উটেছে এ এলাকায় তিনটি সুতা তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় নারী-পুরুষ উভয়ে মিলে কাজ করছেন। বর্তমানে ক্ষুদ্র এ কুটির হস্তশিল্পটি দেশের সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়লেও এ শিল্পের পেছনের কারিগরদের নাম রয়েছে অজানা। এ গ্রামে তৈরি হয় বাচ্চাদের দোলনা, শোয়ার দোলনা ও হেসক দোলনা। এ তিন রকমের দোলনা তৈরিতে বাচ্চাদের দোলনায় খরচ পড়ে ১৮০টাকা, শোয়ার দোলনা ৩৫০টাকা, হেসক দোলনা ১৮০০ টাকা। বাচ্চাদের দোলনা তৈরির পর বিক্রি করা হয় ২২০ টাকা, শোয়ার দোলনা ৪০০ টাকা ও হেসক দোলনা ২১০০ টাকা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ৩০বছর আগে আব্দুল মজিদ ভূঁইয়ার ছেলে কবির ভূঁইয়া প্রথমে এ গ্রামে দোলনা তৈরির কাজ শুরু করেন। পরে তার কাছ থেকে দোলনা তৈরি শিখে হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার এ পেশায় আসলেও বর্তমানে এ পেশা ছড়িয়েছে পাঁচ গ্রামের প্রায় পাঁচ হাজার পরিবারের মাঝে। এছাড়া এ পাঁচ গ্রাম থেকে মাসে প্রায় দুই লাখ দোলনা তৈরি হয়ে যায় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। দৈয়ারা গ্রামের অধিকাংশ বাড়িতে নারীরা তৈরি করছেন দোলনা। নারীদের পাশাপাশি পরিবারের শিশু-কিশোররাও তৈরি করছেন দোলনা। কেউ বাড়ির উঠানে কেউবা পুকুরপাড়ে আবার ঘরের মধ্যে সারিবদ্ধভাবে একের পর এক তৈরি করা হচ্ছে দোলনা। নারীরা দোলনা তৈরির জন্য সুতা বুনলেও এসব দোলনা তৈরির জন্য বাশের তৈরি চাক (ফ্রেম) তৈরি করেন পুরুষেরা। আকারবেধে বাচ্চাদের দোলনা প্রতি মজুরি ২৫ টাকা, শোয়ার দোলনা ৫০ টাকা, হেসক দোলনা ১৫০ টাকা মজুরির বিনিময়ে এসব দোলনা তুলে দেন মহাজনদের হাতে।

দেলোয়ারা বেগম নামে এক দোলনা তৈরির কারিগর বলেন, ‘আমি প্রায় ১৮বছর যাবৎ এ দোলনা তৈরির পেশার সাথে সম্পৃক্ত আছি। আমার মতো এ এলাকার অধিকাংশ নারীরা এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত। আগে নিজেরা সবকিছু সংগ্রহ করে দোলনা বুনে বাজারে বিক্রি করতাম। বর্তমানে এলাকায় কিছু মহাজন আছে তাদের কাছ থেকে মজুরির বিনিময়ে দোলনা বুনি। সবকিছুর দাম বাড়লেও বর্তমানে আমোদের মজুরি আর বাড়েনি। আমাদের যদি সরকারের পক্ষ থেকে সহজ শর্তে ঋণ দেয়া হত তাহলে আমরা নিজেরাই দোলনা তৈরি করে বাজারজাত করতে পারতাম। আমরা চাই সরকারের হস্তক্ষেপে এ হস্তশিল্পে নজর দেয়া হোক। এ শিল্পে সরকারের নজরে আসলে আমাদের জীবনযাত্রার মান কিছু হলেও উন্নতি হবে।’

দোলনা ব্যবসায়ী মোসলেম মিয়া বলেন, ‘এ এলাকার বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি ঘুরে দোলনা কিনে সংগ্রহ করি। সপ্তাহের বিভিন্ন দিনে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে যাই। আমার মতো অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা এখান থেকে দোলনা কিনে দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে নিয়ে যান। বাজারে সুতার তৈরি দোলনার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।’

দৈয়ারা গ্রামের দোলনা তৈরির প্রথম কারিগর কবির ভুইয়া বলেন, ‘আমি প্রথমে কারুশিল্পের কাজ করতাম। কারু কাজের মালামাল দেশের বিভিন্ন হাটবাজারে নিয়ে বিক্রি করতাম। একদিন ঢাকায় কারুশিল্পের মালামাল বিক্রি করতে গেলে ঢাকার এক ব্যবসায়ী আমাকে সুতার তৈরি দোলনার একটি ছবি দেখায়। আমাকে প্রস্তাব করে ছবির দেখানো অবিকল দোলনা আমি তৈরি করে দিতে পারব কিনা। পরে আমি বাড়িতে ফিরে দুই মাসের চেষ্টায় এ দোলনা তৈরি করি এবং তা বাজারজাত করি। পর্যায়ক্রমে এ দোলনার চাহিদা বাড়লে এলাকার কয়েকটি পরিবার আমার সাথে যোগ দেয় এ দোলনা তৈরির কাজে। বর্তমানে এ এলাকাসহ আশপাশের পাঁচ হাজার পরিবার এ দোলনা তৈরির পেশার সাথে সম্পৃক্ত। দোলনা তৈরি করে অনেক পরিবার স্বাবলম্বী হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করলে এ ক্ষুদ্র কুটির হস্তশিল্পটি আরো বহুদূর এগিয়ে যাবে।’

বাবুটিপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আরমান মিয়া বলেন, ‘এ দোলনা তৈরির শিল্পটি বহু বছর যাবত দৈয়ারাসহ আশপাশের এলাকার মানুষের পেশা হয়ে আছে। যুগের পর যুগ কারিগররা এ পেশায় যুক্ত থাকলেও তাদের ভাগ্যের তেমন পরিবর্তন হয়নি। এ হস্তশিল্পটির প্রতি নজর দেয়ার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’