সাদাপাথরসহ সিলেটের বিভিন্ন পর্যটন স্পট থেকে লুট হওয়া পাথর উদ্ধারে প্রশাসনের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। প্রশাসনের ধারাবাহিক অভিযানে এখন পর্যন্ত মোট ১২ লাখ ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে প্রতিস্থাপন হয়েছে ৭ লাখ ঘনফুট। এদিকে লুট হওয়া পাথর ফিরিয়ে দিতে জেলা প্রশাসনের তিন দিনের আল্টিমেটামের প্রথম দিনে ফিরেছে ২ লাখ ঘনফুট পাথর।
সিলেট সদর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা থেকে লোকজন স্বেচ্ছায় সাদাপাথর এলাকায় গিয়ে পাথরগুলো জমা দিয়ে আসেন বলে জানিয়েছেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: সারওয়ার আলম।
দৈনিক নয়া দিগন্তকে এ প্রশাসক জানান, ‘চুরি হওয়া পাথর ফেরাতে আমরা তিন দিনের সময় দিয়েছিলাম। এরমধ্যে প্রথম দিনে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। জমা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ঘনফুট পাথর। আমাদের প্রত্যাশা বাকী দু’দিনে আরো অনেক পাথর যথাস্থানে ফেরত যাবে। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সাদাপাথরসহ সবগুলো পর্যটন স্পটের সৌন্দর্য রক্ষা করা হবে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৮ সালে বেলাসহ কয়েকটি পরিবেশবাদী সংগঠনের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন পাথর কোয়ারি পরিবেশ ও প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করে এসব স্থান থেকে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ করে সরকার। এরপর থেকে কাগজ-কলমে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও বাস্তবের চিত্র ছিল উল্টো। তখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে পাথর উত্তোলন করতেন। সেই সময় মাঝে মাঝে নামকাওয়াস্তে অভিযান হলেও কার্যকর উদ্যোগ চোখে পড়েনি।
এদিকে গত বছরের ৫ আগস্টের পরে সিলেটের সাদাপাথর লুটপাট হয়েছে সবচেয়ে বেশি। টাস্কফোর্সের অভিযান ও পাথর খেকোদের লুকোচুরি ছিল নিত্যদিনের চিত্র। পাথরকাণ্ডে কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুরে বেশ কয়েকজন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মী বহিষ্কৃত হন। মামলার আসামি হওয়ার সাথে কারাগারেও গিয়েছেন সংগঠনটির কেউ কেউ। এরপরেও থেমে থাকেনি পাথর লুটপাট।
স্থানীয়রা জানান, চলতি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে সাদাপাথরসহ সিলেটের সকল পর্যটন স্পটে পাথর লুটে রীতিমতো হরিলুটের ঘটনা ঘটে। দিনরাত সমানতালে হাজার হাজার শ্রমিক কোদাল, বেলচা, শাবল আর টুকরি নিয়ে কোয়ারি ও এর আশপাশের এলাকায় গিয়ে মাটি খুঁড়ে পাথর বের করেন। হাজার হাজার বারকি নৌকায় সেসব পাথর বহন করে এনে মিলমালিকদের কাছে বিক্রি করেন তারা। পরে সেসব পাথর মেশিনে ভেঙে ছোট করে ব্যবসায়ীদের কাছে সরবরাহ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ব্যবসায়ীরা ট্রাক ও পিকআপে করে পাথর দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠান বলে জানা গেছে।
আরো জানান, কয়েক দিনের প্রকাশ্যে পাথর লুটপাটের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। সাদাপাথর ও জাফলং পর্যটন কেন্দ্রের লাখ লাখ ঘনফুট পাথর লুটের ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয় সারাদেশে। নড়েচড়ে বসে সরকার। এমনকি রিট হয় উচ্চ আদালতেও। পরে আদালত লুণ্ঠিত পাথর উদ্ধার করে যথাস্থানে প্রতিস্থাপনেরও নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ আগস্ট সন্ধ্যায় সিলেট সার্কিট হাউজে সিলেট বিভাগীয় ও জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে প্রশাসনের সর্বস্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় পাথর লুটপাট ঠেকানো ও লুটের পাথর সাদাপাথরে পুনঃস্থাপনে পাঁচ দফা সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সিদ্ধান্তগুলো হলো- জাফলং ইসিএ এলাকা ও সাদাপাথর এলাকায় ২৪ ঘণ্টা যৌথবাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। গোয়াইনঘাট ও কোম্পানীগঞ্জে পুলিশের চেকপোস্টে যৌথ বাহিনীসহ সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করবে। অবৈধ ক্রাশিং মেশিনের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নসহ বন্ধ করার জন্য অভিযান চলমান থাকবে। পাথর চুরির সাথে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করে গ্রেফতার ও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এছাড়া চুরি হওয়া পাথর উদ্ধার করে পূর্বের অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে হবে। একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়।
জানা যায়, শেষ পর্যন্ত পাথর লুট কাণ্ডে সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: মাহবুব মুরাদকে প্রত্যাহার করা হয়। বদলি করা হয় কোম্পানীগঞ্জের ইউএনওকেও। এছাড়া খনিজ সম্পদ ব্যুরোর পক্ষ থেকে ২ হাজার জনকে অজ্ঞাত আসামি করে একটি মামলা করা হয়।
এদিকে সাদাপাথর লুটের ঘটনায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে পাঁচ সদস্যের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে আগামী ১০ দিনের মধ্যে দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে প্রতিবেদন দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত শুক্রবার (২৩ আগস্ট) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো: মোখলেস-উর-রহমানের নেতৃত্বে মাঠপর্যায়ে পরিদর্শনে আসের মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি দল। তারা সাদাপাথর পরিদর্শন করেন। একইসাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারি দেন।
সিলেট জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ১২ দিনে এখন পর্যন্ত লুট হওয়া ১২ লাখ ঘনফুট পাথর উদ্ধার করা হয়। রোববার (২৪ আগস্ট) পর্যন্ত ৭ লাখ ঘনফুট পাথর প্রতিস্থাপন করা হয়েছে।
এদিকে শনিবার (২৩ আগস্ট) লুকিয়ে রাখা পাথরগুলো ফিরিয়ে দিতে তিন দিনের আল্টিমেটাম দেন সিলেটের জেলা প্রশাসন। দুপুর ১২টার দিকে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সর্বসাধারণের সাথে উপজেলা প্রশাসনের মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্ত দেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) পদ্মসন সিংহ। এরপর বিভিন্ন উপজেলা জুড়ে চলে মাইকিং। এতে বলা হয় তিন দিন পরে যদি কারো কাছে সাদাপাথর পাওয়া যায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। পরে রোববার সকাল থেকে লোকজন দলে দলে পাথর নিয়ে ছুটে যান সাদাপাথর ঘাটে। ফিরত দিয়ে আসেন লুট করে নেয়া পাথর। রোববার সারাদিনে আনুমানিক ২ লাখ ঘনফুট পাথর ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: সারওয়ার আলম দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানান, ‘লুটপাটের ঘটনার পর যৌথবাহিনীর অভিযান ও প্রশাসনিক তৎপরতায় এখন পর্যন্ত লুট হওয়া প্রায় ১২ লাখ ঘনফুট পাথর জব্দ করা হয়েছে। এরমধ্যে প্রতিস্থাপন হয়েছে ৭ লাখ ঘনফুট। বাকিগুলো প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সিলেটর সকল পর্যটন স্পটের সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে এবং লুটকৃত পাথর উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত থাকবে। এছাড়া পাথর লুটে জড়িতদের চিহ্নিত করতে তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে প্রকৃত দোষীদের আইনের আওতায় আনা হবে। পাশাপাশি তিনি পুনরায় স্বেচ্ছায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লুটকৃত পাথর ফেরত দেয়ার আহ্বান জানান।’