কিংবদন্তি লালন শিল্পী কুষ্টিয়ার কৃতি সন্তান ফরিদা পারভীনকে তার শেষ ইচ্ছে পূরণে কুষ্টিয়া পৌর গোরস্থানের বাবা-মায়ের কবরস্থানে সমাহিত করা হলো। রোববার বাদ এশা হাজার হাজার মুসল্লীর অংশগ্রহনে অনুষ্ঠিত হয় ফরিদা পারভিনের দ্বিতীয় জানাজা নামাজ। এসময় তার দুই সন্তানসহ পাশেই ছিলেন একমাত্র কন্যা ও আত্মীয় স্বজনেরা।
জানাজা শুরুর আগে তার বড় ছেলে উপস্থিত মুসল্লীদের নিকট মায়ের জন্য সকলের দোয়া কামনা করেন। এসময় কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফিন উপস্থিত থেকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান। বিশিষ্ট গবেষক ফরহাদ মজহার ও ফরিদা পারভিনের স্বামী বংশীবাদক গাজী আব্দুল হাকিম উপস্থিত ছিলেন। ফরহাদ মজহার ‘নব প্রান আন্দোলন’র পক্ষ থেকে কবরস্থানে পুস্প অর্পণ করেন।
ফরিদা পারভিনের মৃত্যুতে শৈশব ও কৈশর কাটানো কুষ্টিয়ার সংস্কৃতি অঙ্গনের মানুষের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। লালন সংগীতের মাধ্যমে দেশের মানচিত্র ছাঁড়িয়ে বিশ্বের মাঝে কুষ্টিয়াকে সম্মানিত করা ফরিদা পারভিনের লাশের অপেক্ষায় ছিল জেলাবাসী।
মরহুমের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়- তার শেষ ইচ্ছে পুরণ করতেই ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে জানাযা শেষে ফরিদা পারভিনের লাশ কুষ্টিয়ায় আনা হয়। লাশ পৌঁছানোর পর আত্মীয় স্বজন ও ভক্ত ও গুণগ্রাহীদের কান্নায় সেখানকার পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। বৃষ্টি ও কাদা উপেক্ষা করে জানাজায় শরীক হওয়ার জন্য এবং শেষবারের মত দেখতে সব বয়সের নারী ও পুরুষেরা উপস্থিত হন সেখানে। বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শিল্পী ফরিদা পারভিনের দুই ছেলে ও এক মেয়ে।
ফরিদা পারভিন গীতিকার সূরকার ও বিশিষ্ট শিক্ষাবীদ মরহুম অধ্যাপক আবু জাফরের সহধর্র্মীনি ছিলেন। মধ্যবর্তি সময়ে ফরিদা পারভিনের সাথে অধ্যাপক আবু জাফরের বিবাহ বিচ্ছেদের ঘটনার পর ফরিদা পারভিন একজন বংশীবাদক গাজী মিয়ার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। শেষ মুহুর্তে হাসপাতালে চিকিৎসা এবং মৃত্যুর সময় পর্যন্ত তার সন্তানেরা দেখভাল করেছেন।
কুষ্টিয়া সাংস্কৃতিক অঙ্গনের অতিপরিচিত মুখ ও শিল্পী ফরিদা পারভিনের বন্ধু অ্যাডভোকেট লালিম হক ফরিদা পারভিনের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তিনি জানান, ফরিদা পারভিনের বাবার বাড়ি নাটোর জেলায় হলেও বাবা চাকরি করতেন কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে। সেই সুবাদে কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কে তাদের নিজস্ব আবাসস্থান ছিল। ফরিদা পারভিন কলেজ জীবনে সর্বপ্রথম দোল পুর্নিমায় লালন মাজারে ‘সত্য বল সুপথে চল, ওরে আমার মন’ এই গান গেয়ে পুরো মঞ্চ মাতিয়ে তুলেন। এখন অবধি লালনের এই গানটি সর্বস্তরে ব্যাপক সমাদিত ও প্রশংসিত। ফরিদা পারভিন মকসেদ সাঁইজির হাতে খড়ি ছিলেন। তিনি খোদা বক্স সাঁই, করিম সাঁই, ব্রজেন দাসের মত গুনী শিল্পীদের সান্নিধ্যে লালন গানের তালিম নিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী সুরকার ও গীতিকার মরহুম অধ্যাপক আবু জাফরের লেখা ‘ এই পদ্মা, এই মেঘনা সুরমা নদী বয়ে, সহ বিপুল গানের মাধ্যমে পরিচিতি লাভ করেন তিনি।
কুষ্টিয়া শিল্পকলা অ্যাকাডেমির সাধারণ সম্পাদক আমরিুল ইসলাম বলেন, ফরিদা আপা জেলার সাংস্কৃতি অঙ্গনের মধ্যমনি ছিলেন। তিনি কুষ্টিয়াবাসীকে ভালবেসে তাঁর সংগীত অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তার অভাব কোনো দিনই পুরনের নয়।
ফরিদা পারভিনের বান্ধবী কুষ্টিয়ার বিশিষ্ট সংগীত শিল্পী ও আবৃত্তিকার আলম আরা জুঁই নয়া দিগন্তকে জানান, ফরিদা পারভিন একদিনে জম্ম হয়নি। তার একাগ্রতা, মেধা আর মননের মাধ্যমে লালনের গান গেয়ে দেশের মানুষকে বিমোহিত করেছিলেন। ফরিদা পারভিন কুষ্টিয়া মীর মশাররফর হোসেন মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যাালয় ও কুষ্টিয়া সরকারী বালিকা বিদ্যালয় থেকে স্কুলের গন্ডি ছাড়িয়ে কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে এইচএসসি ও পরবর্তিতে একই কলেজ থেকে বাংলায় অনার্স নিয়ে লেখা পাড় শেষ করেন। পরবর্তিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাকোত্তর শেষ করেন।
মূলত ফরিদা ছিল নজরুল সংগীত শিল্পী। রাজশাহী বেতারে সে অসংখ্যবার গান গেয়েছেন। মকসেদ সাঁইজির তালিমে তিনি লালন গানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন। পরবর্তিতে লালনের দোল পুর্নিমার একটি গান তার জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছে।