কমেছে ডিম ও ব্রয়লার মুরগীর দাম, দিশেহারা কুলিয়ারচরের পোল্ট্রি খামারিরা

ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম কমে যাওয়ায় কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে প্রান্তিক খামারিরা এখন চরম লোকসানের মুখ দেখছেন। উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারদর কম হওয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে ক্ষতির পরিমাণ।

কাইসার হামিদ, কুলিয়ারচর (কিশোরগঞ্জ)

Location :

Kuliarchar
কমেছে ডিম ও ব্রয়লার মুরগীর দাম, দিশেহারা কুলিয়ারচরের পোল্ট্রি খামারিরা
কমেছে ডিম ও ব্রয়লার মুরগীর দাম, দিশেহারা কুলিয়ারচরের পোল্ট্রি খামারিরা |নয়া দিগন্ত

ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম কমে যাওয়ায় কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে প্রান্তিক খামারিরা এখন চরম লোকসানের মুখ দেখছেন। উৎপাদন খরচের তুলনায় বাজারদর কম হওয়ায় প্রতিদিনই বাড়ছে ক্ষতির পরিমাণ। অনেক খামারি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন, কেউ কেউ খামার বন্ধ করার কথাও ভাবছেন। আবার কেউ কেউ খামার বন্ধ করেও দিয়েছেন।

উপজেলার পূর্ব গোবরিয়া গ্রামের খামারি শরিফ ও পশ্চিম গোবরিয়া গ্রামের হাবিবুর রহমান (মাসুদ) বর্তমানে সাড়ে ছয় হাজার লেয়ার মুরগি ডিম উৎপাদনে রেখেছেন। পাশাপাশি আরো চার হাজার লেয়ার পুলেট পালন করছেন, যেগুলো কিছুদিন পর ডিম দেয়া শুরু করবে। সব মিলিয়ে তাদের খামারে এখন সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি মুরগি রয়েছে।

প্রায় এক কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা এই খামারি এখন বড় সঙ্কটে পড়েছেন। ডিমের দাম কমে যাওয়ায় উৎপাদনরত লেয়ার খামার থেকে প্রতিদিনই প্রায় তিন হাজার টাকা লোকসান হচ্ছে। গত দুই মাসেই কমপক্ষে সাত লাখ টাকা লোকসান হয়েছে।

শরিফ বলেন, ‘মুরগী ও ডিমের দাম যদি এভাবে কমে যায়, তাহলে আমাদের পক্ষে আর বেশিদিন খামার চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না।’

সালুয়া ইউনিয়নের এক খামারি, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, জানান যে, তিনি ব্যাংক ঋণ নিয়ে দুই হাজার ডিমপাড়া লেয়ার মুরগির খামার করেছিলেন। তবে ডিমের দাম কমে যাওয়ায় তিনিও বড় ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছেন। তিনি বলেন, এই অবস্থায় ঋণের কিস্তি কীভাবে দেবো তা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছাড়া আর কিছু নেই।

কুলিয়ারচর উপজেলা পোল্ট্রি ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও নিউ সততা পোল্ট্রি ফিডের সত্ত্বাধিকারী মো: আরশ মিয়া জানান, ‘ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দাম কমে যাওয়ায় খামারিরা মুরগীর খাদ্য বা ফিড ঠিকমতো কিনতে পারছে না। অনেক খামারির খামারের জন্য খাবার সরবরাহ করা এখন কষ্টসাধ্য হয়ে গেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ডিম প্রতি উৎপাদনে তাদের খরচ পড়ে প্রায় ১০ টাকা। সরকার নির্ধারিত খামার মূল্য ডিম প্রতি ১০.৫৮ টাকা থেকে ১১.০১ টাকা ছিলো। কিন্তু বর্তমান বাজারে ডিম বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ৭ টাকা ২০ পয়সা থেকে ৭ টাকা ৫০ পয়সা দরে। ফলে প্রতিটি ডিমে প্রায় ২.৫০ টাকা থেকে ৩ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। অপরদিকে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগী উৎপাদনে তাদের খরচ পড়ে প্রায় ১৪৫ টাকা। সরকার নির্ধারিত খামার মূল্য কেজি প্রতি ১৬০ টাকা থেকে ১৬২ টাকা ছিলো। কিন্তু বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগী বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ১১০ টাকা থেকে ১২২ টাকা দরে। ফলে প্রতি কেজি মুরগী প্রায় ৩০ টাকা থেকে ৩৫ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।’

এছাড়া প্রতি কেজি কালার বার্ড মুরগী উৎপাদনে তাদের খরচ পড়ে প্রায় ২১০ টাকা। সরকার নির্ধারিত খামার মূল্য কেজি প্রতি ২৩০ টাকা ছিলো। কিন্তু বর্তমান বাজারে প্রতি কেজি কালার বার্ড মুরগী বিক্রি করতে হচ্ছে মাত্র ১৪৮ টাকা থেকে ১৫৫ টাকা দরে। ফলে প্রতি কেজি কালার বার্ড মুরগী প্রায় ৫০ টাকা থেকে ৬০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।

এছাড়া তিনি আরো বলেন, ‘বিভিন্ন করপোরেট ফিড কোম্পানিগুলোর মধ্যে কাজী, সিপি, প্যারাগন, ৭১, সগোনা ও তামীম ইত্যাদি কোম্পানিগুলো কন্ট্রাক খামারিদের নিকট থেকে ব্ল্যাংক চেক ও সম্পত্তির দলিল নিয়ে তাদের জিম্মি করে মুরগী উৎপাদন করে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে প্রান্তিক খামারিদের ধ্বংস করে দিচ্ছে।’

কুলিয়ারচর উপজেলা পোল্ট্রি ডিলার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও খাঁন পোল্ট্রি ফিডের সত্ত্বাধিকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা মো: আলী আকবর খাঁন বলেন, ‘ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম কমে যাওয়ায় কুলিয়ারচরে পোল্ট্রি খামারিরা মারাত্মক লোকসানে পড়েছেন; উৎপাদন খরচও উঠছে না, ফলে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে, যেখানে খাবারের দাম বেশি এবং ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের দাম কম, এমন পরিস্থিতিতে অনেক খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন।’

ডুমরাকান্দা বাজারের তালুকদার পোল্ট্রির ম্যানেজার জয়নাল বলেন, ‘খামারিরা এখন আগের মতো ওষুধ কিনছে না। ফলে আমাদের বিক্রয় ও কোম্পানির ঔষধের বিল সঠিকভাবে পরিশোধ করতে পারছি না।’

কুলিয়ারচরের বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং প্রতিনিধিরা জানান, তারা স্থানীয় ডিলারদের মাধ্যমে ওষুধ বিক্রি করেন। তবে ব্রয়লার মুরগি ও ডিমের বাজার কমে যাওয়ায় খামারিরা এখন ওষুধ কিনতে পারছেন না। ফলে বিল ও বিক্রয় ঠিকমতো সম্পন্ন হচ্ছে না, যা সরাসরি কোম্পানির ব্যবসায় প্রভাব ফেলছে।

খামারিরা বলেন, লাভ তো দূরের কথা এক দুই মাসের ব্যবধানে খামার পর্যায়ে প্রতি ডিমে লোকসান গুনতে হচ্ছে ২.৫০ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত, অপরদিকে ব্রয়লার মুরগী প্রতি কেজিতে লোকসান গুনতে হচ্ছে ৩০ থেকে ৩৫ টাকা পর্যন্ত।

অন্যদিকে ভ্যাকসিন ও ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারিদের খরচও অনেক বেড়েছে। ডিম ও মুরগির বাজারদর উৎপাদন খরচের নিচে নেমে যাওয়ায় পুঁজি রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়েছে, অনেক খামারি উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারি ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, যা পোল্ট্রি শিল্পের জন্য বড় হুমকি। সামগ্রিকভাবে পোল্ট্রি শিল্পের জন্য একটি বড় সঙ্কট তৈরি করেছে।

এ ব্যাপারে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো: মাহফুজ উদ্দিন ভূইয়া বলেন, কুলিয়ারচর উপজেলায় প্রায় ২ শত লিয়ার মুরগীর খামারে ২ লাখের মতো মুরগী রয়েছে। এসব মুরগী থেকে বছরে প্রায় ৫ কোটি ডিম উৎপাদন হয়। এসব ডিম কুলিয়ারচরের চাহিদা মিটিয়ে পাশের উপজেলাগুলোসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়।

প্রতি ডিমে খামারিদের উৎপাদন খরচ ৯ টাকার মতো। বর্তমান বাজারে প্রতি ডিম বিক্রি হচ্ছে ৭.৫০ টাকা দরে। এ অনুযায়ী দেখা যায় খামারিরা ডিম প্রতি ১.৫০ টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে।

কেন, কি কারণে ডিমের বাজার মূল্য কমে গেছে তা খতিয়ে দেখার জন্য আমাদের সার্বিক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এছাড়া মুরগীর বাচ্চার দাম সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে কোনো কোম্পানি যদি বেশি দামে বিক্রি করে তা দেখার জন্য তদারকি চলছে। কোনো রকম প্রমাণ পাওয়া গেলে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে।