টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত, মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা

বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হতে না পারা, নদী-খাল খনন প্রকল্পে অনিয়ম, নদী-খালের প্রশস্ততা কমিয়ে ফেলা, সরকারি খাল দখল করে মৎস্য ঘের গড়ে তোলাই নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ার মূল কারণ বলছেন স্থানীয়রা।

মুহা: জিললুর রহমান, সাতক্ষীরা

Location :

Satkhira
টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত |নয়া দিগন্ত

গত কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে সাতক্ষীরা শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গেছে পুকুর, জলাশয়, মাছের ঘেরসহ বাড়িঘর। এছাড়া ল্যাট্রিন ও টিউবওয়েল তলিয়ে গেছে বলে জানা গেছে। এতে খাবারের পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে।

এদিকে রান্না ঘরে পানি উঠায় অনেক পরিবারের খাওয়া বন্ধের উপক্রম হয়েছে। পানি নিষ্কাশিত হতে না পারায় বিভিন্ন এলাকায় এমন দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন বলেও জানা গেছে।

জানা যায়, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত হতে না পারা, নদী-খাল খনন প্রকল্পে অনিয়ম, নদী-খালের প্রশস্ততা কমিয়ে ফেলা, তলদেশ খনন না করে পাড় উঁচু করে গভীরতা দেখানো, পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে ও সরকারি খাল দখল করে মৎস্য ঘের গড়ে তোলা, অবৈধভাবে খালে দেয়া নেট-পাটা দিয়ে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করাসহ পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে সাতক্ষীরায় জলাবদ্ধতার দেখা দিয়েছে। ক্রমেই পানি বৃদ্ধির কারণে মানবিক বিপর্যয়ের শঙ্কা দেখা দিয়েছে গোটা এলাকায়।

শুক্রবার (৪ জুলাই) বিকেলে শহরের নিম্নাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, সাতক্ষীরা পৌরসভার কামালনগর, ইটাগাছা, মেহেদীবাগ, রসুলপুর, বদ্দীপুর কলোনি, রইচপুর, মধ্য কাটিয়া, রথখোলা, রাজার বাগান, মুনজিতপুর, গদাইবিল ও পুরাতন সাতক্ষীরার নিম্ন এলাকায় ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। পানিতে তলিয়ে গেছে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতাল চত্বরও। ভেলায় চড়ে স্কুল-কলেজে যেতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের।

পৌর সভার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মাওলানা আব্দুর রহিম বলেন, ‘পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) ও পৌর সভার কর্মকর্তাদের গাফিলতি ও অনিয়মের খেসারত দিতে হচ্ছে সাতক্ষীরাবাসীকে।’

তিনি বলেন, ‘কোটি টাকার নদী খনন প্রকল্পে অনিয়মের কারণে নদী ও খাল খননের প্রকৃত উদ্দেশ্য হাসিল হচ্ছে না। খননের নামে নদী-খালের প্রশস্ততা কমিয়ে ফেলা হয়। তলদেশ খনন না করে পাড় উঁচু করে গভীরতা দেখানো হয়েছে। ফলে স্থলভাগের পানি নদীতে যায় না। উপরন্তু নদীর পানি বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পানি নিষ্কাশনের পথ না থাকায় সাতক্ষীরা পৌরসভা ও সদর উপজেলার বিভিন্ন এলাকা বছরে চার থেকে ছয় মাস জলাবদ্ধতা থাকে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, পৌরসভার মধ্যে পানি নিষ্কাশনের পথ বন্ধ করে ও সরকারি খালগুলো দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে শত শত মৎস্য ঘের। ফলে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশিত না হয়ে সাতক্ষীরা পৌরসভার বিভিন্ন এলাকা জলাবদ্ধ হয়ে থাকে মাসের পর মাস।

ইটাগাছা আয়েনউদ্দীন মাদরাসা এলাকার ফারুক হোসেন জানান, ‘বাড়িঘরে পানি উঠেছে। এতে টিউবয়েলগুলোও অকেজো হয়ে পড়েছে। ঘর থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। অনেকে পাশের এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন। এছাড়া এলাকায় খাবারের পানির সঙ্কট দেখা দিয়েছে। দ্রুত সময়ে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের উদ্যোগ না নিলে এলাকায় মানবিক বিপর্যয় দেখা দিবে।’

পৌর এলাকার সাবিনা বেগম জানান, ‘একদিন ভাত না খেয়ে বেঁচে থাকা যায়। কিন্তু পানি না খেয়ে থাকা যায় না। এখন কোথাও খাওয়ার পানি নেই। ভেলায় করে দূরদূরান্ত থেকে পানি আনতে হচ্ছে।’

একই এলাকার আব্দুল হামিদ বলেন, ‘বর্তমানে এলাকায় কোনো ব্যক্তি মারা গেলে তার দাফন করার মতো উঁচু জায়গাও নেই। সব বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত। গত কয়েক বছর ধরে এলাকা কম বেশি প্লাবিত হলেও এবারের চিত্রটি সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।’

জলাবদ্ধতা এলাকায় ঘুরে ভুক্তভোগীদের সাতে কথা বলে সাতক্ষীরা শহর জামায়াতের আমির জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিরসনে সরকার নদী খননের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেয়। কিন্তু অপরিকল্পিত খননের কারণে তা যায় পানিতে, কাজের কাজ কিছুই হয় না। রাস্তাঘাট, মসজিদ, মন্দির, স্কুল-কলেজ সব পানিতে ডুবে জনজীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। গোয়াল ঘরে পানি ওঠায় গরু ছাগল নিয়েও চরম বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। সেইসাথে গো খাদ্যের সঙ্কট দেখা দিয়েছে।’

অপরিকল্পিত নদী খনন ও মৎস্য ঘেরই এর জন্য দায়ী বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাতক্ষীরা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শোয়াইব আহমাদ বলেন, ‘শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে ঘের মালিকসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে দফায় দফায় কথা বলেছি। তারা পানি নিষ্কাশনে দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যে জলাবদ্ধতা হ্রাস পাবে।’