জুলাই আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ সুজনের বেঁচে থাকার আর্তনাদ!

বর্তমানে নিয়মিত ওষুধ খেয়েই কোমরের ব্যথা কমিয়ে রেখেই চলছে তার জীবন। তবে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন এ যুবক।

লালমোহন (ভোলা) সংবাদদাতা

Location :

Lalmohan
আহত জহিরুল ইসলাম সুজন
আহত জহিরুল ইসলাম সুজন |নয়া দিগন্ত

২০২৪ সালের ১৮ জুলাই। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উত্তাল রাজধানী ঢাকা। অন্যদিকে আন্দোলন দমাতে নির্বিচারে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও গুলি চালাচ্ছে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। নিরীহ শিক্ষার্থীদের ওপর এমন নির্মমতা দেখে প্রতিবাদী হয়ে এগিয়ে যান ৩৭ বছর বয়সী যুবক জহিরুল ইসলাম সুজন। মতিঝিলের নটরডেম কলেজ সংলগ্ন এলাকায় ফাস্ট ফুডের দোকান ছিল তার।

এদিকে দোকানের সুবাদে আন্দোলনকারী বহু শিক্ষার্থী ও হামলাকারীদের অনেককেই চিনতেন সুজন। এতে শিক্ষার্থীদের ওপর চলা নির্মমতা মানতে পারেননি তিনি। ১৮ জুলাই দুপুরের দিকে শিক্ষার্থীদের সাথে আন্দোলনে যোগ দিয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন সুজন। তবে বিকেল গড়াতেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের পিস্তল থেকে ছুড়া একটি গুলি ভেদ করে তার মেরুদণ্ডের ভেতর। অমনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন সুজন। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হসপিটালে নিয়ে যায় শিক্ষার্থীরা।

তবে দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেয়ার পরেও মৃত্যু শঙ্কায় মেরুদণ্ড থেকে বের করা সম্ভব হয়নি ওই গুলি। বর্তমানে নিয়মিত ওষুধ খেয়েই কোমরের ব্যথা কমিয়ে রেখেই চলছে তার জীবন। তবে স্বাভাবিক কাজকর্ম করতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন এ যুবক।

এদিকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন পরিবারের অন্য সদস্যরা। অর্থাভাবে অসহায় জীবন পার করছেন সুজন ও তার পরিবার।

মেরুদণ্ড থেকে গুলি বের করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আকুতির যেন শেষ নেই সুজনের। ফলে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করতে সরকারের কাছে আর্তনাদ জানিয়েছেন তিনি।

জহিরুল ইসলাম সুজন ভোলার লালমোহন উপজেলার ধলীগৌরনগর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের করিমগঞ্জ এলাকার মো: কামাল উদ্দিনের ছেলে।

আন্দোলনে আহত সুজন জানান, ‘গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর ঢাকা মেডিক্যালে ১৫ দিন চিকিৎসাধীন ছিলাম। এরপর আমাকে সাভার সিআরপি হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে প্রায় ছয় মাস চিকিৎসা নিয়েছি। তখন চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, আমার মেরুদণ্ডের ভেতর ঢুকে যাওয়া গুলি বের করতে হলে মৃত্যুর শঙ্কা বেশি। পরে আর গুলিটি বের করেননি তারা। পরে কিছুটা স্বস্তি অনুভব করায় চিকিৎসকের অনুমতি নিয়ে বাড়িতে আসি।’

তিনি জানান, ‘বাড়ি আসার দু’মাসের মাথায় আবারো প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হয়। পরে অসহনীয় যন্ত্রণায় ঢাকা সিএমএইচ হাসপাতালে ভর্তি হই। তার কয়েকদিন পরেই বাবা মারা যান। তারপর আর ঢাকায় যাওয়া হয়নি। আন্দোলনে আহতদের মধ্যে সরকারি তালিকায় ৩৩৭ নম্বরে আমার নাম রয়েছে।’

তিনি আরো জানান, মেরুদণ্ডের ভেতর এখনো গুলি থাকায় কোমরের নিচের পুরো অংশ অবশ হয়ে গেছে। ফলে কোমড়ে প্রচুর ব্যথা হয়। এছাড়া অবশ হওয়া অংশটি দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে। নিজে চলাফেরা করতে পারি না। সারাদিন বাড়িতে শুয়ে থাকতে হয়। ওষুধ খেলে ব্যথা কিছুটা কমে। এখন প্রতিদিন ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার ওষুধ খেতে হয়। এ নিয়ে অর্থ সঙ্কটে ভুগছি।’

আন্দোলনে আহত এ যুবক বলেন, স্ত্রীসহ আমার তিন সন্তান রয়েছে। এরা সবাই আমার ওপর নির্ভরশীল। আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর সরকারিভাবে চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য দুই লাখ টাকা অনুদান পেয়েছি। তবে ওই টাকা দিয়ে সংসারে খরচ করার পাশাপাশি চিকিৎসাও চালিয়েছি। এদিকে বাবা জীবিত থাকার সময় বিভিন্নভাবে আমাদের সহযোগিতা করেছেন। এখন তিনিও নেই। সব মিলিয়ে চিকিৎসা খরচ ও সংসার চালাতে নিরুপায় হয়ে পড়েছি। এছাড়া আমার সবগুলো সন্তান পড়াশোনা করে, তাদের একটা ভবিষ্যৎ আছে!

তাই সরকারের কাছে উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া এবং সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানিয়েছেন সুজন। একইসাথে স্বৈরাচারমুক্ত দেশে একদিনের জন্য হলেও স্বাধীনভাবে চলার আকুতি জানিয়েছেন এ যোদ্ধা।

এ বিষয়ে লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো: শাহ আজিজ বলেন, ‘২৪-এর জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে যারা শহীদ ও আহত হয়েছেন তাদের জন্য সরকারি যে-সব বরাদ্দ এসেছিল তা আমরা পৌঁছে দিয়েছি। এছাড়া পরবর্তী সময়ে এসব ব্যক্তিদের জন্য কোনো বরাদ্দ এলে তাও সঠিকভাবে পৌঁছে দেয়া হবে।’