রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প থেকে চাকরিচ্যুত স্থানীয় শিক্ষকরা চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে কক্সবাজার-টেকনাফ মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন।
সোমবার (১৮ আগস্ট) সকাল ৬টা থেকে উখিয়ার কোটবাজার স্টেশনে শুরু হওয়া এ কর্মসূচি বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত চলে। দীর্ঘ ১০ ঘণ্টার অবরোধে মহাসড়কের দুই পাশে কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। শত শত বাস, ট্রাক, প্রাইভেটকার ও সিএনজি অটোরিকশা আটকা পড়ে দুর্ভোগে পড়েন হাজারো যাত্রী।
চাকরিচ্যুত শিক্ষকরা দাবি তুলেছেন, বিনা কারণে তাদের চাকরি থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। জীবিকার অনিশ্চয়তায় পড়ে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে দিশাহারা হয়ে পড়েছেন।
আন্দোলনকারীদের সমন্বয়ক মো: শামীম বলেন, ‘জনদুর্ভোগের কথা চিন্তা করে অবরোধ সাময়িকভাবে তুলে নিয়েছি। তবে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। মঙ্গলবার উখিয়া নাকি কক্সবাজারে কর্মসূচি দেয়া হবে তা রাতে সিদ্ধান্ত জানানো হবে।’
অবরোধ চলাকালে ঘটনাস্থলে পুলিশ, র্যাব ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখেন। দুপুরে কক্সবাজারের পুলিশ সুপার সাইফুদ্দিন শাহীনসহ জেলা প্রশাসন ও শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের কর্মকর্তারা আন্দোলনকারীদের সাথে কথা বলেন।
পুলিশ সুপার জানান, ‘যারা চাকরি হারিয়েছেন তাদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। একটি এনজিওর মাধ্যমে ১৫০ জনকে নতুন করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, বাকিদের জন্যও আবেদন করা হয়েছে। তবে রাস্তায় নেমে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।
আন্দোলনে অংশ নেয়া শিক্ষক বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে ক্যাম্পে শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত ছিলাম। হঠাৎ বিনা কারণে চাকরি হারালাম। অথচ রোহিঙ্গা শিক্ষকদের রাখা হচ্ছে, আমাদের বাদ দেয়া হয়েছে। এতে আমরা পরিবার নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়েছি।’
অবরোধে আটকে পড়া যাত্রী ও চালকদের ভোগান্তিও ছিল চরম। সিএনজি চালক নুরুল আলম বলেন, ‘৫ ঘণ্টা ধরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। যাত্রী হেঁটে চলে গেছে।’
ট্রাকচালক রহিম উদ্দিন বলেন, ‘সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এক জায়গায় বসে আছি, খাওয়াও হয়নি। তবে স্থানীয় শিক্ষকদের চাকরি হারানো অন্যায়।’
উখিয়ার ইউএনও মোহাম্মদ কামরুল হাসান জানান, ‘সমস্যাটি মূলত ইউনিসেফ ও শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের সাথে শিক্ষকদের। আমরা সবাইকে নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করছি।’
তবে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমানের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
সংকটের পেছনের কারণ
গত ২ জুন ইউনিসেফ কক্সবাজার কার্যালয় জানিয়েছিল, তহবিল সংকটের কারণে রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রম সীমিত করা হবে। আশ্রয়শিবিরে পরিচালিত সাড়ে চার হাজার লার্নিং সেন্টারে প্রায় দুই লাখ ৩০ হাজার শিশু পড়াশোনা করে। কিন্তু তহবিল সংকটের কারণে জুনের পর শিক্ষা কার্যক্রম চালু থাকবে কি না, তা নির্ভর করছে নতুন অনুদানের ওপর।
ইউনিসেফের কক্সবাজার কার্যালয়ের প্রধান কর্মকর্তা এঞ্জেলা কার্নে বলেছিলেন, সীমিত প্রকল্পে গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ পর্যায়ের স্থানীয় শিক্ষকরা আর চাকরিতে থাকবেন না। এতে অন্তত এক হাজার ১৭৯ জন বাংলাদেশী শিক্ষক চাকরি হারান।
তিনি আরো জানান, নতুন শিক্ষা কার্যক্রমে বিজ্ঞান, ইংরেজি ও সামাজিক শিক্ষা বাদ দিয়ে বার্মিজ ভাষা, গণিত, জীবন দক্ষতা ও সামাজিক মানসিক শিক্ষায় জোর দেয়া হবে। সেখানে যুক্ত হবেন মূলত রোহিঙ্গা শিক্ষকরা। নতুন বইও আর দেয়া হবে না, বরং আগের বই ঘুরিয়ে ব্যবহার করা হবে।
ফলে দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা কার্যক্রমে যুক্ত স্থানীয় শিক্ষকরা নিজেদের অবিচারের শিকার মনে করছেন। তাদের অভিযোগ, রোহিঙ্গা শিক্ষকদের চাকরিতে রেখে দেশী শিক্ষকদের বাদ দেয়া হয়েছে, যা বৈষম্যমূলক।
এ ঘটনায় ইতিমধ্যে উখিয়া ও টেকনাফে একাধিকবার আন্দোলন হয়েছে। সোমবারের মহাসড়ক অবরোধ তারই অংশ, যা ভবিষ্যতে আরো বড় আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।