দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতা ও বিচার ব্যবস্থার চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে একটি পৃথক বাণিজ্যিক আদালত ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ঘোষণা করেছেন প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
রোববার (১৭ আগস্ট) দুপুরে সিলেটের একটি অভিজাত হোটেলে ‘এস্টাবলিশিং কমার্শিয়াল কোর্টস : শেপিং দ্যা ড্রাফট কমার্শিয়াল কোর্ট অর্ডিন্যান্স’ -শীর্ষক একটি সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেয়ার সময় তিনি এ কথা বলেন।
সেমিনারটির দ্বিতীয় সেশন বা মূল পর্ব (প্ল্যানারি সেশন) শুরু হয় দুপুর ১২ টার দিকে। বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট এবং ইউনাইটেড ন্যাশন্স ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনডিপি) এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত উক্ত সেমিনারের মূল পর্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে বাণিজ্যিক বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কোনো পৃথক বিচারিক ফোরাম নেই। এখন কোটি কোটি টাকার বাণিজ্যিক বিরোধগুলোকে ছোটখাটো দেওয়ানি মামলার সাথে একই সারিতে নিষ্পত্তি করায় দ্রুত, কার্যকর বিচার প্রক্রিয়া ব্যাহত হচ্ছে। এটি আমাদের বিচারকদের প্রতি কোনো সমালোচনা নয়। তাদের নিষ্ঠা প্রশ্নাতীত বরং এটি একটি কাঠামোগত অসংগতি। এর ফলে মামলার জট যেমন বাড়ছে, তেমনি ব্যবসায়িক সম্পর্ক ও বিনিয়োগ পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’
তিনি একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, ‘২০২৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত শুধু অর্থ ঋণ আদালতে প্রায় ২৫ হাজারেরও বেশি মামলা অমীমাংসিত রয়ে গেছে।’
পৃথক বাণিজ্যিক আদালত প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এটি কারো একক কোনো দাবি নয় বরং বাণিজ্যিক মামলাগুলো বিশেষায়িত আদালতে নির্দিষ্ট সময়সীমা ও কার্যকর রায়ের মধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়ার জন্য বৃহৎ বিনিয়োগকারী থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারী সবাই দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সভা-সেমিনারে এই দাবি জানিয়ে আসছে।’
তিনি বৈশ্বিক উদাহরণ তুলে ধরে বলেন, ‘রুয়ান্ডা, ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশগুলো বাণিজ্যিক আদালত গড়ে তুলে একটি দক্ষ, স্বচ্ছ ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি করেছে।’
তিনি বলেন, ‘এ সকল দেশের অভিজ্ঞতাগুলো বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা বহন করে।’
প্রধান বিচারপতি প্রস্তাবিত বাণিজ্যিক আদালত ব্যবস্থার সাতটি মূল স্তম্ভের কথা উল্লেখ করেন। সেগুলো হলো, স্পষ্ট ও একীভূত এখতিয়ার নির্ধারণ, আর্থিক সীমারেখা ও স্তরভিত্তিক কাঠামো, বাধ্যতামূলক কেস ম্যানেজমেন্ট ও কঠোর সময়সীমা, সমন্বিত মধ্যস্থতা ব্যবস্থা, প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার (যেমন, ই-ফাইলিং, ডিজিটাল ট্র্যাকিং, হাইব্রিড শুনানি), সবার জন্য ন্যায়সঙ্গত প্রবেশাধিকার, এবং জবাবদিহি ও কর্মক্ষমতা পর্যবেক্ষণ।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘বাণিজ্যিক আদালতের কার্যক্রম হবে পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক এবং বাণিজ্যের পরিবর্তনশীল চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।’
প্রধান বিচারপতি আরো জানান, আদালত প্রতিষ্ঠার পর বিচারকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেয়া হবে, মিশ্র আইনব্যবস্থার (সিভিল ল ও কমন ল-এর সমন্বয়) সুফল কাজে লাগানো হবে এবং বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে জবাবদিহি নিশ্চিত করা হবে। এটি আমাদের জন্য এক অনন্য সুযোগ। শুধু একটি নতুন আদালত গঠন নয়, বরং অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের জন্য এক নতুন ভিত্তি গড়ে তোলা। আজ আমরা সম্মিলিতভাবে সেই পথে এগিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করছি।
সেমিনারের দ্বিতীয় সেশন বা মূল পর্বে সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন সিলেটের সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমান।
এই সেশনে আরো বক্তব্য রাখেন- বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, ইউএনডিপি এর রেসিডেন্সিয়াল রিপ্রেজেনটেটিভ স্টিফান লিলার এবং সেমিনারের সভাপতি হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জাফর আহমেদ।
এছাড়া, সেমিনারে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন দূতাবাসের প্রতিনিধি, বিআইডিএ’এর প্রতিনিধি, বিআইএকে’এর প্রতিনিধি, সুপ্রীম কোর্ট রেজিস্ট্রির কর্মকর্তারা, বিজ্ঞ আইনজীবীরা এবং সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বিভিন্ন পর্যায়ের বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ওই সেমিনারে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উপস্থিতির ব্যাপারে বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের পরামর্শক্রমে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আইন ও বিচার বিভাগের প্রশিক্ষণ শাখা হতে চলতি বছরের ১৩ আগস্ট তারিখে এ সংক্রান্ত সরকারি আদেশ জারি হয়।