তিন পার্বত্য জেলায় বাজারফান্ড জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক ঋণ নেয়ার প্রক্রিয়া পুনরায় চালুর দাবি

বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) এ দাবিতে পিসিসিপি খাগড়াছড়ি জেলা শাখার পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়।

রফিকুল ইসলাম রকি, খাগড়াছড়ি

Location :

Khagrachari
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক নাজমুন আরা সুলতানার কাছে স্মারকলিপি হস্তান্তর করে পিসিসিপি
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক নাজমুন আরা সুলতানার কাছে স্মারকলিপি হস্তান্তর করে পিসিসিপি |নয়া দিগন্ত

খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের বাজারফান্ড জমি বন্ধক রেখে ব্যাংক ঋণ নেয়ার প্রক্রিয়া পুনরায় চালু ও বন্ধকী মেয়াদ বৃদ্ধি করার দাবি জানিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র পরিষদ (পিসিসিপি)।

বৃহস্পতিবার (২৮ আগস্ট) এ দাবিতে পিসিসিপি খাগড়াছড়ি জেলা শাখার পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেয়া হয়। খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের স্থানীয় সরকার উপ-পরিচালক নাজমুন আরা সুলতানা স্মারকলিপি গ্রহণ করেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে দীর্ঘ বছর ধরে বাজারফান্ড জমি নিয়ে প্রশাসনিক জটিলতার কারণে স্থানীয় ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাজারফান্ড জমি মর্টগেজ (বন্ধক) দিয়ে ঋণ নিতে না পারায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা অর্থ সংকটে ভুগছেন। এতে ব্যবসার পরিধি ছোট হচ্ছে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না, বাড়ছে বেকারত্ব। একইসাথে এখানকার বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোও বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। বাজারফান্ড এলাকায় ব্যবসা সংকোচন ও ব্যবসায়ীদের মাঝে হতাশা বাড়ছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করছেন, শহরকেন্দ্রিক বাজারফান্ড জমির দাম বেশি হলেও প্রশাসনিক জটিলতার কারণে ব্যাংক ঋণ মিলছে না। ফলে ব্যবসায়ীরা বাধ্য হচ্ছেন মূলধন সংকটে পড়তে। অনেকে ইতোমধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছেন। নতুন উদ্যোক্তারা ঝুঁকি নিতে পারছেন না, কর্মসংস্থানের সুযোগও তৈরি হচ্ছে না।

বাজারফান্ড জমির লিজ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতার বিষয়ে এতে বলা হয়, ঐতিহাসিকভাবে বাজারফান্ডের জমি (বাজার এলাকার দোকানঘর, পাট, দোকানঘাট) জেলা পরিষদের মাধ্যমে ৯৯ বছর মেয়াদে বন্দোবস্তি (লিজ) দেয়া হতো। অর্থাৎ একবার লিজ নিলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ব্যবসায়ীরা নিশ্চিন্তে ব্যবহার করতে পারতেন। দীর্ঘমেয়াদী এই লিজ থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা জমি/দোকানকে স্থায়ী সম্পদ হিসেবে দেখতেন। ব্যাংকেও বন্ধক রেখে সহজে ঋণ পাওয়া যেত। এতে স্থায়ীভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তারের সুযোগ তৈরি হতো।

পরবর্তী সময়ে জেলা পরিষদ/প্রশাসন লিজের মেয়াদ ৯৯ বছর থেকে কমিয়ে মাত্র ১০ বছর করে দেয়। মেয়াদ পরিবর্তনের বিষয়টি পার্বত্য চট্টগ্রামের বাঙালি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী উভয়ের জন্যই বড় অর্থনৈতিক প্রভাব ফেলেছে। এই পরিবর্তন আনুষ্ঠানিকভাবে আনা হয় মূলত ২০১০ সালের পর থেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত/পরিপত্রের মাধ্যমে।

দশ বছরের লিজে কোনো ব্যাংক সহজে ঋণ দেয় না। কারণ মর্টগেজ সিকিউরিটি দুর্বল হয়। ব্যবসায়ীরা স্থায়ী অবকাঠামো বিনিয়োগে আগ্রহ হারান। দোকান/জমি উন্নয়ন খরচ তুলতে গেলে অন্তত ১৫-২০ বছর লাগে। মাত্র ১০ বছরের মেয়াদে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এতে করে ব্যবসা গুটিয়ে যাচ্ছে, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না। ব্যাংকগুলোও সম্ভাব্য ঋণ বাণিজ্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

২০১৭ সালে রাঙ্গামাটির তৎকালীন জেলা প্রশাসক প্রথমবার বাজারফান্ড এলাকার ভূমি রেজিস্ট্রির মিউটেশন মামলা স্থগিত করেন। তখন নানা দেন-দরবারের পর তা চালু হলেও ২০১৯ সালে আবার বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ব্যবসায়ীরা ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

বাজারফান্ড জমি নিয়ে মূল জটিলতা শুর হয় ২০১৭ সালে, যখন রাঙ্গামাটির তৎকালীন জেলা প্রশাসক মানজারল মান্নান ঋণ চুক্তি রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। পরবর্তীতে খাগড়াছড়ির তৎকালীন জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস ২০১৯ সালে বাজারফান্ড বন্দোবস্তি জমিকে "খাস জমি" আখ্যা দিয়ে ঋণ প্রদানের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এবং মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা চান।

তার পদক্ষেপ অনুসরণ করে রাঙামাটি ও বান্দরবান জেলা প্রশাসকরাও একইভাবে ঋণ চুক্তি রেজিস্ট্রেশন কার্যক্রম স্থগিত করে দেন। ফলে একযোগে তিন পার্বত্য জেলায় ব্যবসায়ীরা বাজারফান্ড জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেয়ার সুযোগ হারান।

স্মারকলিপিতে আইনের উল্লেখ করে বলা হয়, ১৯০০ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসন বিধির ১২ (২) ধারা অনুযায়ী, ঋণগ্রহীতা ও ব্যাংকের মধ্যে চুক্তি রেজিস্ট্রেশন করার এখতিয়ার জেলা প্রশাসকের। তবে বাজারফান্ডের জমি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়ার ক্ষমতা জেলা পরিষদের।

জেলা পরিষদ আইন ১৯৮৯ এর ধারা, এবং ১৯৯৭ চুক্তির পরবর্তী সংশোধনীতে প্রণীত জেলা পরিষদ আইন অনুযায়ী বাজারফান্ড জেলা পরিষদের অধীনে ন্যস্ত। অর্থাৎ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হচ্ছেন বাজারফান্ড প্রশাসক। তিনি ভূমি বন্দোবস্তির ক্ষমতা রাখলেও জেলা প্রশাসক কেবল রেজিস্ট্রেশনের দায়িত্বে আছেন। তাই জেলা প্রশাসন আইনত বাজারফান্ড জমি বন্ধক প্রক্রিয়া আটকে রাখতে পারেন না।

রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান বৃষকেতু চাকমা বিষয়টি মন্ত্রণালয়কে লিখিতভাবে জানান। তার মতে স্থায়ীভাবে বন্দোবস্তি প্রদানের নিয়ম বিদ্যমান।

ব্যাংকগুলো লোকসানের ব্যাপারে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয় প্রশাসনিক জটের কারণে কেবল ব্যবসায়ীই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন না, ব্যাংকগুলোরও ক্ষতি হচ্ছে। খাগড়াছড়িতে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি প্রায় ২০টি ব্যাংক প্রতিদিন গড়ে ৬০-৭০ কোটি টাকার লেনদেন করে। কিন্তু বাজারফান্ড জমি বন্ধক গ্রহণ করতে না পারায় বছরে অন্তত ১০০ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ করতে পারছে না ব্যাংকগুলো।

মর্টগেজ না নেয়ার ব্যাপারে ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, বাজারফান্ড জমির আইনি জট না মেটায় এসব জমি মর্টগেজ নেয়া যাচ্ছে না। ফলে অনেক ব্যবসায়ী ঋণ পাচ্ছেন না, ব্যাংকও বিনিয়োগ করতে পারছে না।

বাজারফান্ড জমি বন্ধক রেখে ঋণ নেয়া দীর্ঘদিনের প্রথা উল্লেখ করে পিসিসিপি কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সম্পাদক জানান, হঠাৎ জেলা প্রশাসকদের এই সিদ্ধান্ত রহস্যজনক। এটি কোনো অদৃশ্য শক্তির নীলনকশা হতে পারে।

উক্ত জটিলতা নিরসনে বারবার পার্বত্য জেলা প্রশাসকদের আহ্বান করলেও বিষয়টি নিরসনে দ্রুত উদ্যোগ নিচ্ছে না এমন হতাশা প্রকাশ করে নেতৃবৃন্দ।

বাজারফান্ড জমি নিয়ে প্রশাসনিক জটিলতা যতদিন অবসান না হবে, ততদিন পাহাড়ের ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ সংকুচিত হতে থাকবে এমন উদ্বেগ জানিয়ে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বাজারফান্ড জমি নিয়ে প্রশাসনিক জটিলতা নিরসন করে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান বের করতে দ্রুত উদ্যোগ নেয়ার জোর দাবি জানানো হয়। অন্যথায় তিন পার্বত্য জেলার জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও করে অবরুদ্ধ করে রাখার মতো বৃহত্তর কর্মসূচি ঘোষণা দেয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয় স্মারকলিপিতে।

এসময় উপস্থিত ছিলেন পিসিসিপির কেন্দ্রীয় সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন কায়েশ, খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান, কলেজ কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম জুনায়েদ, সদর উপজেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক সাগর খান, জেলা কমিটির ছাত্রবিষয়ক সহ-সম্পাদক ওসমান আহমেদসহ খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজ শাখাসহ জেলার বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ।