রংপুর মহানগরীতে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত

রংপুর মহানগরীতে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় নানা ঐতিহ্যবাহী উপকরণের প্রদর্শণী ছিল। ছিল ঠেংগা, ঘোড়ার গাড়ি, গড়ুর গাড়ি, ভ্যান রিকশাসহ নিত্যদিনের ব্যবহার্য নানা উপকরণ। ছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী নানা আলপনা, মোটিফ।

সরকার মাজহারুল মান্নান, রংপুর ব্যুরো

Location :

Rangpur Sadar
রংপুর মহানগরীতে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা
রংপুর মহানগরীতে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা |নয়া দিগন্ত

কেউ খেলছেন লাঠি খেলা, কেউ ধরছেন মাছ। কারো হাতে লাঙ্গল জোয়াল, কেউ বয়ে চলেছেন পালকি। রংপুর মহানগরীতে বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রায় এ ধরণের নানা ঐতিহ্যবাহী উপকরণের প্রদর্শণী ছিল। ছিল ঠেংগা, ঘোড়ার গাড়ি, গড়ুর গাড়ি, ভ্যান রিকশাসহ নিত্যদিনের ব্যবহার্য নানা উপকরণ। ছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী নানা আলপনা, মোটিফ।

সোমবার (১৪ এপ্রিল) বেলা সোয়া ১১ টার দিকে জিলা স্কুলের প্রধান গেটে শোভাযাত্রার উদ্বোধন করেন বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলাম।

এসময় সাথে ছিলেন রেঞ্জ ডিআইজি মো: আমিনুল ইসলাম, মহানগর পুলিশ কমিশনার মজিদ আলী, ডিসি মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল, এসপি আবু সাঈমসহ সরকারী কর্মকর্তা কর্মচারীদের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সংগঠন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শ্রেণি পেশার হাজার হাজার মানুষ। দেড় ঘণ্টাব্যাপী নগরীর প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে শোভাযাত্রাটি। যা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়।

এর আগে জিলা স্কুলের বটতলায় জেলা প্রশাসন এবং পাবলিক লাইব্রেরী মাঠে শুরু হয় সাংস্কৃতিক ঐক্য পরিষদের পরিবেশনা। পরে টাউন হল মাঠে উদ্বোধন করা হয় ৫ দিনব্যাপী মেলার। বিভিন্ন বয়সি ও শ্রেণি পেশার হাজার হাজার মানুষ অংশ নেন উৎসবে। এছাড়াও রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে হয় শোভাযাত্রা ও মেলা।

উৎসবে অংশ নেয়া সবার কণ্ঠে ছিলো আয়োজনে ছিল প্রাণ। ছিল না কোনো আতংক। সবার কণ্ঠের ৫ আগস্ট পরবর্তী বাংলাদেশ বিনির্মাণে ঐতিহ্য লালন পালন করার প্রত্যয়।

জিলা স্কুল মাঠে অংশ নেয়া চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী নোহা জানালেন,‘আমি প্রথমবার আসলাম। যখন থ্রিতে পড়ি। তখন এধরণের আয়োজন করা হয়নি। এই প্রথমবার আমি এতো বড় আয়োজন দেখলাম। আমি হ্যাপি।’

জিলা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী আহনাফ বলেন, ‘এখানে গান কবিতা আবৃত্তি সব সুন্দর হচ্ছে। অনেক বন্ধুদের সাথে দেখা হলো। গত বারও হয়েছিল। তবে এবারের আয়োজনটা একটু বেশি সুন্দর। বেশি বড়। এবার সব কিছু সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। স্টেজটা সুন্দর করা হয়েছে। এছাড়াও যে দেয়ালিকাগুলো আঁকা হয়েছে সেগুলো আরো সুন্দর।’

জিলা স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহমি। তার ভাষায় এবার উৎসবটা একটু বড়। কারণ এবার দুর্নীতি নাই। কোনো ভয় নাই। আমাদের সব বন্ধু বান্ধবরা আমরা একটা পরিবারে জড়ো হয়ে গেছি। আমাদের মাঝে ঐক্যটা এবার একটু বেশি মনে হচ্ছে। সেকারণে আনন্দটাও একটু খানি বেশি।’

পুলিশ লাইন্স স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহসিন জানালেন,‘আমরা এবার দেশটাকে নতুন হিসেবে পেয়েছি। আগের স্বৈরাচারমুক্ত দেশ ছিল না। এবার স্বৈরাচারমুক্ত দেশ পেয়েছি। এবার আয়োজন অনেক বড়। আমি খুব খুশি সব কিছু দেখে। এর আগেরবার এতো বড় আয়োজন ছিল না।’

উৎসবে অংশ নেয়া কেরানিপাড়ার অভিভাবক শামসুন্নাহার জানালেন, ‘আমরা আমৃত্য বাঙ্গালী থাকতে চাই। এবারের উৎসবটা যেমন ভীতিহীনভাবে নিজের মতো করে কাটালাম। আমাদের ঐতিহ্য যেন ঠিক সেভাবেই থাকে। সেটা আমরা সারাবছর যেন আমরা এভাবেই কাটাতে পারি।’

আরেক অভিভাবক ফরিদা ইয়াসমিন এসেছিলেন নীলকণ্ঠ এলাকা থেকে। তিনি জানালেন, এদেশে যেন আর কোনো স্বৈরাচার রাজা না আসে। আমাদের দেশ এবং প্রজন্মরা যেন একটা সুন্দর পরিবেশ পায়। আমরা দুর্নীতি মুক্ত দেশ চাই। এটাই নতুন বছরে প্রত্যাশা করি আমরা।

আয়োজক রংপুর ডিসি মোহাম্মাদ রবিউল ফয়সাল জানান, ‘আমাদের আয়োজনের সব আয়োজনের মটো হলো সকল বৈষম্য দুর করার অঙ্গিকার। সেকারণে আনন্দ শোভাযাত্রা, মেলা এবং অন্য আয়োজন। অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বড় করেছি। আমাদের সব ঐতিহ্য আমরা ফুটিয়ে তুলেছি নতন প্রজন্মের হাতে। একটি ফ্যাসিবাদ এবং হ্যাজিমনি বিরোধী বাংলাদেশে বিনির্মাণই আমাদের প্রত্যয়।

রংপুর মহানগর কমিশনার মো: মজিদ আলী জানান, ‘চট্রগাম এবং ঢাকায় সামান্য ঘটনা ঘটেছে। সেকারণে আমরা নির্ঘুম রাত কাটিয়েছি। সেকারণে শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের উৎসব পালন হচ্ছে।’

রংপুর রেঞ্জ ডিআইজি মো: আমিনুল ইসলাম জানান, ‘যাদের রক্তের বিনিময়ে বৈষম্যহীন প্রেক্ষাপটে নববর্ষ উদযাপন করছি। সেই জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট যেন আমরা ভুলে না যাই। এই স্পিরিটকে সামনে রেখেই বৈষম্যহীন সমাজ আমাদের গড়তেই হবে। রংপুর বিভাগের আট জেলা এবং সমস্ত উপজেলায় নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। পতিত স্বৈরাচারিরা এখনও চেষ্টা করছে বিশৃঙখলা তৈরি করতে। তাদের আমরা ছাড় দেবো না। বিশেষ করে বর্ষরবরণের অনুষ্ঠানে ঢুকে কোনো ধরণের অপতৎপরতা চালালে আমরা কঠোরভাবে মোকাবেলা করবো।

রংপুর বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলাম জানান, আমাদের অঙ্গিকার একটাই হোক। সেটা হলো এতোদিন আমরা বিশেষ করে ১৫/১৬ বছর আমরা দেশের সিংহভাগ মানুষকে বঞ্চিত করে উদযাপিত হয়েছে। যেখানে কোনো অনাবিল আনন্দ ছিল না। শুধু লুটেরাদের আনন্দ ছিল। এবার পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা সব থেকে বড় উৎসবের মধ্য দিয়ে বর্ষবরণ করছি। সবাই মিলে একসাথে। আমরা আর ভেদাভেদ রাখতে চাই না। এইভাবে যে চলা আমরা শুরু করলাম। সেটা যেন অনন্তকাল ধরে বহমান থাকে।

রংপুর সাংস্কৃতিক ঐক্য পরিষদের উপদেস্টা জহির আলম নয়ন জানান, এবার ৫৪ টি সাহিত্য সাংস্কৃতিক ও আবৃত্তি সংগঠনের সম্মিলিতভাবে আমরা পাবলিকলাইব্রেরী মাঠে বর্ষবরণের বিভিন্ন পরিবেশনা করছি। যা অতীতে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মানুষের স্বতস্ফুর্ত অংশগ্রহণে প্রমাণ হয়েছে বিগত ১৬ বছর তারা দম বন্ধ পরিস্থিতিতে ছিল। এবার তার মুক্ত পরিবেশে উৎসব করতে পারছে।