তুহিন হত্যায় আসামি শাহজালালের স্বীকারোক্তি

‘সাংবাদিক ভিডিও করতেছে’ গোলাপীর এমন চিৎকারেই তুহিনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে সন্ত্রাসীরা

ময়নাতদন্ত রিপোর্টে ৯টি গভীর ক্ষত

‘গোলাপীকে ওই লোকের সাথে হাতাহাতি করতে দেখে দৌড়ে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকেন। কোপ খেয়ে ওই লোক একটা মুদি দোকানে ঢোকেন। ওই সময় গোলাপী চিৎকার করে বলতে থাকেন- তুহিন সাংবাদিক ভিডিও করতেছে। সাথে সাথে ওই লোককে কোঁপানো বাদ দিয়ে তারা সাংবাদিক তুহিনকে ধাওয়া করেন...’

মো: আজিজুল হক, গাজীপুর মহানগর

Location :

Gazipur
তুহিন হত্যায় স্বীকারোক্তি দিয়েছেন আসামি শাহজালাল
তুহিন হত্যায় স্বীকারোক্তি দিয়েছেন আসামি শাহজালাল |ছবি : নয়া দিগন্ত

গাজীপুরে বহুল আলোচিত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যা মামলায় গ্রেফতার সাত আসামির মধ্যে একজন ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বাসন থানায় দুই দিনের রিমান্ড শেষে সাত আসামিকে সোমবার (১১ আগস্ট) দুপুরে গাজীপুর চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-৩ এ হাজির করা হলে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

আসামিদের মধ্যে কুমিল্লার হোমনা থানার অনন্তপুর গ্রামের হানিফ ভূইয়ার ছেলে মো: শাহজালাল (৩২) আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জাবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই দুলাল চন্দ্র দাস বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

প্রদত্ত জবানবন্দিতে শাহজালাল জানান, ‘তিনি ইয়াবা ব্যাবসা করেন এবং ঠেক দিয়ে ছিনতাই করেন। গত ৭ আগস্ট তিনি, মিজান, স্বাধীন, সুমন, আরমান, ফয়সাল এবং আলামিন একসাথে ইয়াবা সেবন করছিলেন। এমন সময় মিজানের স্ত্রী গোলাপী ফোন দিয়ে মিজানকে জানান যে, শাপলা মেনশনের (চান্দনা চৌরাস্তা) কাছে একটা লোক পাওয়া গেছে, তার থেকে ফিটিং দিয়ে টাকা-পয়সা পাওয়া যাবে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা চাপাতি, দা, সুইচ গিয়ার চাকু নিয়ে শাপলা ম্যানশনের দিকে গিয়ে গোলাপীকে ওই লোকের সাথে হাতাহাতি করতে দেখে দৌড়ে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকেন। কোপ খেয়ে ওই লোক একটা মুদি দোকানে ঢোকেন। ওই সময় গোলাপী চিৎকার করে বলতে থাকেন- তুহিন সাংবাদিক ভিডিও করতেছে। সাথে সাথে ওই লোককে কোঁপানো বাদ দিয়ে তারা সাংবাদিক তুহিনকে ধাওয়া করেন, পরে চায়ের দোকানের সামনে প্রথমে মিজান তাকে দা দিয়ে কোপ মারেন, কোপ খেয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকলে স্বাধীন, সুমন, আরমান, আলামিন, ফয়সাল সবাই এলোপাতাড়ি কোপান এবং মিজান সুযোগ বুঝে সাংবাদিকের মোবাইল পকেটে নিয়ে যান। এই সময় গোলাপী পুলিশ আসতেছে বলে চিৎকার করলে তারা সবাই পালিয়ে যান।’

এর আগে দুই দিনের রিমান্ড শেষে দুপুরে কড়া পুলিশি প্রহরায় সাত আসামিকে আদালতে হাজির করা হয়। এদের মধ্যে আসামি মো: শাহজালালকে ওই আদালতের বিচারক ওমর হায়দারের কাছে হাজির করা হলে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যার সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় উপরোক্ত স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেন।

তদন্তকারী কর্মকর্তা আরো বলেন, রিমান্ডে থাকা অবস্থায় সাত আসামিকে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ সময় তারা তুহিন হত্যা সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তাদের দেয়া তথ্যযাচাই-বাছাই করা হবে। তবে তদন্তের স্বার্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত আর জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেন ওই কর্মকর্তা।

ময়নাতদন্তে সাংবাদিক তুহিনের দেহে মিলেছে ৯টি গভীর ক্ষত
সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের দেহে ৯টি গভীর ক্ষতের বর্ণনা উঠে এসেছে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে। যার প্রত্যেকটি আঘাতই প্রায় সমপরিমাণের এবং মৃত্যু নিশ্চিতের জন্য এগুলোর একটি আঘাতই যথেষ্ট। এ ছাড়া চাপাতির কোপে বাম হাতের হাড় কয়েক টুকরো হয়ে গেছে এবং ঝাঁজরা হয়ে গেছে বুকের বাম পাশের পাঁজর। গলার ডান পাশের সব ধমনি কেটে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে। ধারালো অস্ত্রের একটি আঘাত পিঠ দিয়ে ঢুকে ফুসফুস বিচ্ছিন্ন হয়ে পাঁজর ভেদ করে বুক দিয়ে বেরিয়ে গেছে। তুহিনকে হত্যার এমন নির্মম চিত্র উঠে এসেছে গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে।

শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা: এএনএম আল মামুন জানান, নিহত তুহিনের গলা, ঘাড়, বুক, পিঠ ও হাতে গুরুতর ৯টি গভীর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। সবচেয়ে বেশি গভীর হয়েছে বুকের বাম পাশে। তা ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি আঘাতই গভীর ও সমান গুরুতর। একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য এর যে কোনো একটি আঘাতই যথেষ্ট।

ময়নাতদন্তের এ প্রতিবেদন ইতোমধ্যেই গাজীপুর মহানগর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা: মাজহারুল হক। এর আগে গত শনিবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে মেডিক্যাল রিপোর্ট (ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন) পাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই সাংবাদিক তুহিন হত্যা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করার আশ্বাস দেন গাজীপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার ড. মো: নাজমুল করিম খান।

সংবাদ সম্মেলনে জিএমপি কমিশনার বলেন, ঘটনার দিন সংঘবদ্ধ চক্র কর্তৃক বাদশা নামের এক ব্যক্তিকে কোপানোর দৃশ্য নিজের মোবাইল ফোনে ভিডিও করতে গিয়ে জীবন দিয়েছেন সাংবাদিক তুহিন। এ ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ ও প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীসহ সব তথ্য-প্রমাণ এখন আমাদের হাতে। মেডিক্যাল রিপোর্টপ্রাপ্তি সাপেক্ষে ১৫ দিনের মধ্যে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হবে। আমরা আশা করি, দ্রুততম সময়ে সাংবাদিক তুহিন হত্যাকাণ্ডের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। সাজার সংস্কৃতি নিশ্চিত করা গেলে ক্রাইম দমন করা যাবে।

জিএমপি উত্তর বিভাগের ডিসি (ক্রাইম) মো: রবিউল হাসান জানান, ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আমরা হাতে পেয়েছি।

এদিকে এ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত সাত আসামিকে শনিবার রাতেই ২ দিনের রিমান্ডে নেয়া হয়। গত শনিবার তাদের প্রত্যেকের ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন জানালে আদালত দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি ‘হানি ট্র্যাপ’ (যৌন প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে ফেলে ছিনতাই) ঘটনার দৃশ্য মোবাইল ফোন দিয়ে ভিডিও ধারণ করার সময় সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে হত্যা করে লাশ ঘটনাস্থলে ফেলে রেখে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় নিহতের বড় ভাই মো: সেলিম বাসন থানায় মামলা দায়ের করেন।