বাংলাদেশের কিংবদন্তি অর্থমন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমানের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। স্বাধীনতার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত ও দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে আধুনিক পথে রূপান্তরিত করেন তিনি। ভেঙে পড়া বেহাল অর্থনৈতিক অবস্থা থেকে দেশকে গড়ে তোলেন তৃতীয় বিশ্বের এক আধুনিক উদীয়মান ইমার্জিন টাইগারের দেশ হিসেবে। দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ গড়ে তোলার নেপথ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব হিসেবে সাইফুর রহমানকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে আজ। এ উপলক্ষে সিলেট ও মৌলভীবাজারে কবর জিয়ারত, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সিলেট সিটি করপোরেশনের দু’মেয়াদের মেয়র এবং এম সাইফুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন আরিফুল হক চৌধুরী দৈনিক নয়া দিগন্তকে জানান, জিয়াউর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিএনপিতে যোগ দিয়েছিলেন সাইফুর রহমান। তবে শর্ত ছিল, সিলেটের উন্নয়ন। সিলেটের উন্নয়নে তার আগে কিংবা পরে আর কেউ এমন বিস্ময়কর অবদান রাখতে পারেননি। জেনারেল ওসমানী, এয়ার ভাইস মার্শাল মাহবুব আলী খান কিংবা স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর উল্লেখযোগ্য অবদান থাকলেও সেগুলো ম্লান হয়ে যায় সাইফুর রহমানের অসাধারণ কর্মকাণ্ডের কাছে। সিলেটের মানুষের ভালোবাসার মাঝেই তিনি অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন।
১৯৯৪ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সিলেটের আলিয়া মাদরাসা মাঠে এক ঐতিহাসিক জনসভায় এম সাইফুর রহমানের একান্ত প্রচেষ্টায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া সিলেট বিভাগ ঘোষণা করেন। ওই সভায় যোগ দেয়ার আগে সার্কিট হাউসে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে সাফ জানিয়ে দেন, আজ বিভাগ ঘোষণা না করা হলে তিনি পদত্যাগ করবেন।
১৯৭৯, ১৯৯৪ এবং ২০০১ সালে বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী এবং সরকারের প্রভাবশালী অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তিনি রেখে গেছেন অসাধারণ সাফল্যের দৃষ্টান্ত। জাতীয় সংসদে টানা ১২ বার বাজেট পেশ করে তিনি গড়েছেন এক অনন্য রেকর্ড। দেশের অর্থনীতিতে নতুন গতি এনে দিতে ভ্যাট চালুর মাধ্যমে রেখেছেন স্থায়ী অবদান।
এক সময় বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী হিসেবে এম সাইফুর রহমান এবং সৌদি আরবের তেলমন্ত্রী জাকি ইয়েমেনির নাম বিশ্বজুড়ে উচ্চারিত হতো। আমেরিকাসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা তাদের চিনতেন ও সম্মান করতেন। বিশ্বব্যাংকের চেয়ারম্যানসহ বহু আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনি। দেশের উন্নয়নে রেখেছেন অনন্য ও অসামান্য অবদান।
জানা যায়, এম সাইফুর রহমান ১৯৭৬ সালে বাণিজ্য উপদেষ্টা হিসেবে জিয়াউর রহমানের উপদেষ্টা পরিষদে যোগদান করেন। পরে তিনি বাণিজ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৮০ সালের ২৫ এপ্রিল থেকে ১৯৮২ সালের ১১ জানুয়ারি পর্যন্ত তদানীন্তন সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে মৌলভীবাজার-৩ সংসদীয় আসন থেকে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান মারা গেলে বিএনপিতে নেমে আসে দুঃসময়। তখন সাইফুর রহমান বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ সরকার সাইফুর রহমানকে গ্রেফতার করে। সাত মাস কারাভোগের পর মুক্তি পেয়ে সাইফুর রহমান খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে তাকে রাজনীতিতে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন।
১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হলে এম সাইফুর রহমান ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এম সাইফুর রহমান ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ ও সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ আসন এবং ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মৌলভীবাজার-৩ ও সিলেট-১ (সদর) সংসদীয় আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। দুটি আসনে বিপুল ভোটে বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সাইফুর রহমান ২০০১ সালে মৌলভীবাজার-৩ আসনটি ছেড়ে দেন এবং ওই আসনে উপ-নির্বাচনে তার জ্যেষ্ঠপুত্র এম নাসের রহমান জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
সাইফুর রহমান ১৯৯১-৯৬ এবং ২০০১-০৬ সময়ে বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প ও কর্মসূচি অনুমোদনে নিয়োজিত সর্বোচ্চ সরকারি সংস্থা জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বিকল্প চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অর্থনীতি ও পরিকল্পনা সংক্রান্ত কেবিনেট কমিটি, জাতীয় পরিসংখ্যান কাউন্সিল, বয়স্ক ভাতা পেনশন সংক্রান্ত কেবিনেট কমিটি, সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কেবিনেট কমিটি, প্রশাসনিক সংস্কার ও সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ সংক্রান্ত কেবিনেট কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
সাইফুর রহমান ১৯৮০- ১৯৮২, ১৯৯১-১৯৯৬ এবং ২০০১-২০০৬ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবি, আইডিবি এবং ইফাদে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তার সুযোগ্য ও দক্ষ নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল ইইসি, এসকাপ, কমনওয়েলথ, ইফাদ, আঙ্কটাড, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফের বিভিন্ন সম্মেলনে অংশগ্রহণ করে।
এছাড়া তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, ইটালি, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, মালয়েশিয়া, তুরস্ক, কানাডা, বেলজিয়াম, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে, অস্ট্রেলিয়া, কলাম্বিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সংলাপে বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেন। তিনি ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত বসনিয়া বিষয়ক ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন এবং একই বছরের অক্টোবরে কার্টাহেনা, কলাম্বিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর সরকারপ্রধানদের সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন।
সাইফুর রহমান কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি এসোসিয়েশনের আয়োজনে ১৯৯৮ সালের জুনে লন্ডনে অনুষ্ঠিত সংসদের বিরোধী দলের অধিকার ও দায়িত্ব বিষয়ক কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেন। জার্মানির বার্লিনে ১৯৯৯ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ১০২তম আইপিইউ সম্মেলনে সাইফুর রহমান যোগদান করেন। ২০০১ সালের অক্টোবরে অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারে সাইফুর রহমান অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তার ওই মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠিত উন্নয়ন বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলন, মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সম্মেলন এবং লন্ডনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ অর্থমন্ত্রীদের সম্মেলনসহ আন্তর্জাতিক সম্মেলনগুলোতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেন।
এম সাইফুর রহমান ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং বাংলাদেশে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্টের বিভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের ওপর বক্তব্য তুলে ধরেন, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি উল্লখযোগ্য লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে রয়েছে। তিনি একই সময়ে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বিশ্বব্যাংকের সভায় বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব প্রদান করেন। ২০০৬ সালের ৮ জুন মহান জাতীয় সংসদে তিনি তার দ্বাদশ বাজেট উপস্থাপন করেন। এটা বাংলাদেশে তার বাজেটের রেকর্ড।
আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে সিলেট নগরীর বন্দরবাজার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে দুপুরে দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। বিকেল ৩টায় শিল্পকলা একাডেমিতে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখবেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. মঈন খান। এছাড়া মৌলভীবাজারে মরহুমের বাড়িতেও কবর জিয়ারত, দোয়া মাহফিল ও আলোচনা সভায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকবেন।