প্রথম শ্রেণির পৌরসভা হয়েও নানাবিধ সমস্যায় দাগনভূঞা পৌরসভা

ফেনী-নোয়খালী রোডের মাতুভুঞা ব্রিজের কাছে মহাসড়কের পাশে বজ্য ফেলার কারণে সড়কে চলাচলকারীরা দাগনভুঞায় প্রবেশ করতে নিদারুণ অসুবিধা ভোগ করেন।

দাগনভূঞা (ফেনী) সংবাদদাতা

Location :

Feni
নানাবিধ সমস্যায় দাগনভূঞা পৌরসভা
নানাবিধ সমস্যায় দাগনভূঞা পৌরসভা |নয়া দিগন্ত

ফেনী জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পৌরসভা হচ্ছে দাগনভূঞা পৌরসভা। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নানা সমস্যা জর্জরিত এই পৌরসভাটি এখনো নাগরিকদের মৌলিক সুবিধা পূরণ করতে পারছে না। রাস্তাঘাটের বেহাল অবস্থা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার করুণ চিত্র, নিরাপদ পানির অভাব এবং সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি, লাইটিং সমস্যা, জলাবদ্ধতাসহ নানা সমস্যায় পৌরবাসীর জীবনযাত্রা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে।

সরেজমিন ঘুরে জানা গেছে, দাগনভূঞা পৌরসভাটি ২০০০ সালের ২ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয়। ২০০৪ সালের ৯ নভেম্বর তারিখে পৌর-৩/চবি/গ-২৯/৯৭/১৩২৪ নম্বর প্রজ্ঞাপনমূলে দ্বিতীয় শ্রেণির পৌরসভায় উন্নীত হয় এবং গত ২০১২ সালের ১৫ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগের পৌর-২ শাখার ৪৬.০৬৪.০২৮.১০.১০.৩০৬.২০১১/৬৩ নম্বর প্রজ্ঞাপন মূলে প্রথম শ্রেণির পৌরসভায় উন্নীত হয়। কিন্তু বিগত সময়ে নানা অব্যবস্থাপনার কারণে পৌরবাসী নানাবিধ নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বিশেষত পৌর এলাকার বজ্য অপসারণের জন্য কোনো ডাম্পিং স্টেশন না থাকার কারণে যততত্র বজ্য ফেলার কারণে নষ্ট হচ্ছে পৌরসভার পরিবেশ। এতে দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ পৌরবাসী, পথচারী ও ব্যবসায়ীরা।

ফেনী-নোয়খালী রোডের মাতুভুঞা ব্রিজের কাছে মহাসড়কের পাশে বজ্য ফেলার কারণে সড়কে চলাচলকারীরা দাগনভুঞায় প্রবেশ করতে নিদারুণ অসুবিধা ভোগ করেন। বিশেষত পাশে থাকা ভাষা শহীদ সালাম মেমোরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থী এবং মাতুভূঞা মাদরাসা ও করিম উল্লা উচ্চ বিদ্যালয়ের কোমল প্রাণ শিক্ষার্থীরা এতে কষ্ট ভোগ করেন।

এছাড়া পৌরসভাধীন খাল ও জলাশয়গুলো পরিষ্কার না করার কারণে বর্ষা মৌসুমে পৌর এলাকার মানুষ জলবদ্ধতায় কষ্ট ভোগ করেন। এসব জলাশয়ে ডেঙ্গু চিকনগুনিয়াসহ নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বাসিন্দারা। তাছাড়া ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমস্যার কারণে পানি জমে থেকে সড়ক ও যানচলাচলে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তোহা বাজার ও মাছ বাজারে নানাবিধ সমস্যার কারণে ক্রেতা ও বিক্রেতাদের দূর্ভোগ পেহাতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সেখানে দ্রুত পানি নামা ও উচুঁ করে রাস্তা ঢালাই করে সংস্কার জরুরি হয়ে পড়ছে।

তাছাড়া স্থায়ী পশু জবেহখানা নির্মাণ করে বর্জ্য সমূহ নিরাপদে অপসারণ করা গেলে বাজারের দূর্গন্ধ কমে আসবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া একটি স্থায়ী পাবলিক টয়লেট না থাকার কারণে পথচারী ও ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমস্যা তৈরি হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে পাবলিক টয়লেট নির্মাণ অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।

এছাড়া পৌর এলাকার বিভিন্ন ওয়ার্ডে সড়কবাতি না থাকার কারণে পথচারীরা নানা বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। দাগনভূঞা বাজারসহ বিভিন্ন ওয়ার্ডে রাস্তা সমূহের বেহাল দশায় এতে চলাচলকারীরা নানা ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। রাস্তার নানা স্থানে গর্তের সৃষ্টি হয়ে যানবাহন চলাচলে সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

অন্যদিকে পৌর এলাকায় শতভাগ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ না থাকায় নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন বাসিন্দারা। এজন্য নির্মানাধীন ওয়াটার প্লান্টের কাজ দ্রুত শেষ করে সমগ্র পৌর এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের দাবি জানান স্থানীয়রা। এছাড়া বিনোদন কেন্দ্র, পৌর পার্ক না থাকার কারণে শহরের বাসিন্দারা চিত্তবিনোদনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

পৌরসভা সূত্রে জানা গেছে, বর্জ্য ফেলার স্থায়ী ডাম্পিং স্টেশনের জন্য সাড়ে ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গ্রীন ডট অ্যান্ড এমকেএমজেবি নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু তারা ১০০ শতক জায়গা না পাওয়ায় কাজ শুরু করতে পারেনি। গত জুনে উক্ত প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। পৌর এলাকায় খাস জমির অভাবের কারণে রামনগর ও জায়লস্করে খাস জমি খোঁজ করেও নানা সমস্যায় তা মেলেনি। তাই বর্জ্য সমস্যায় ভুগছে পৌর কতৃর্পক্ষ।

এছাড়া খোঁজ নিয়ে বিভিন্ন সড়কে সড়ক বাতি লাগানের কাজ চলমান রয়েছে। গত অর্থ বছরে এডিপি প্রকল্পে সোয়া লাখ টাকা দিয়ে ১৮টি সড়কে ৬২৫টি লাইট বসানো হয়েছে। পৌর এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন ৩২ পৌরসভা প্রকল্পের কাজ ৯৫ শতাংশ শেষ হয়েছে। জমি হস্তান্তর প্রক্রিয়া কাজ বাকী রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে পৌর এলাকার পাঁচটি ওয়ার্ডে শতভাগ বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা যাবে।

এছাড়া তরকারি বাজার ও মাছ বাজারের উন্নয়নে ২০১৭-১৮ অর্থ বছরে সাত তলা বিশিষ্ট ভবন নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হলেও কোনো দরদাতা এতে অংশ না নেয়ায় পরে এটি বাস্তবায়ন করা যায়নি। ইতোমধ্যে মাছ বাজারে বৃষ্টি পানি রোধে শেড নির্মাণ করা হয়েছে। সহসাই সিসি ঢালাই করে দেয়া হবে। গরু জবাই খানার আধুনিকায় করা হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে দাদনার খাল সংস্কার কাজ চলছে।

পৌর কর্তৃপক্ষ এস্কেভেটর দিয়ে অনেকগুলো জমে থাকা ময়লা পরিস্কার করেছে। মাতুভূঞা নদী ও দাদনার খাল দিয়ে পানি প্রবাহ নিশ্চিত হলে পৌর এলাকার জলবদ্ধতা দূর হয়ে যাবে। এছাড়া ভেঙে ফেলা পৌর পাবলিক টয়লেট দ্রুত নির্মাণ করা হবে। তাছাড়া অতিবৃষ্টি ও জলবদ্ধতার কারণে নানা স্থানে সড়কে গর্ত তৈরী হয়েছে। বৃষ্টির মৌসুম শেষ হলে এ নিয়ে কাজ করা হবে।

দাগনভূঞা পৌর এলাকার আলাইয়া পুরের বাসিন্দা নুর ইসলাম খোকন নয়া দিগন্তকে জানান, পৌরসভার গুরুত্বপূর্ণ অনেকগুলো রাস্তাগুলো খানাখন্দে ভরা। এতে গাড়ি চালানো দায় হয়ে পড়েছে। বর্ষা মৌসুমে পানি জমে চলাচল এক প্রকার অসম্ভব হয়ে পড়ে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় বৃষ্টির পানি জমে থেকে সৃষ্টি করছে মশা-মাছির উপদ্রব ও স্বাস্থ্যঝুঁকি। পৌরসভার নাম থাকলেও বাস্তবে আমরা গ্রামের মতোই বসবাস করছি। প্রতিটি নির্বাচনের আগে উন্নয়নের আশ্বাস শুনি, কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয় না।

দাগনভূঞা পৌরসভার সাবেক প্যানেল মেয়র কামাল হোসেন নয়া দিগন্তকে জানান, দীর্ঘ দিনের একদলীয় শাসনের যাতাকলে পড়ে পৌর এলাকার এ দশা হয়েছে। বিগত সময়ে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারেনি ফলে উন্নয়ন কাজের এ বেহাল দশা। অব্যবস্থাপনা, জবাবদিহিতা ও আন্তরিকতা না থাকার ফলে যা হওয়ার তা হয়েছে। যার কুফল ভোগ করছে পৌরবাসী।

তিনি বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও খাল দখল করে বসতি গড়ে তোলার জন্য জলাবদ্ধতায় ভুগছে পৌরবাসী। লোক দেখানো কাজ না করে খাল সমূহ সব সময় পরিস্কার করে পানি প্রবাহ চালু করা জরুরি। আশার কথা হচ্ছে, বর্তমান পৌর প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা স, ম আজহারুল ইসলাম এসব বিষয়ে নিরলস কাজ করে চলছেন। উনার আন্তরিকতায় ইতোমধ্যে কিছু কাজের অগ্রগতি হয়েছে।

দাগনভূঞা পৌরসভা সহকারী প্রকৌশলী জুনায়েদ কাওছার সৌরভ নয়া দিগন্তকে বলেন, পৌর এলাকার রাস্তা সমূহ অতিবৃষ্টির কারণে খানা খন্দকের সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষা বন্ধ হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তা মেরামত করা হবে। এছাড়া তরকারি বাজার মাছ বাজারের উন্নয়নে ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল ও নালা সমূহ পরিস্কার, পাবলিক টয়লেট নির্মাণ ও লাইটিং-সহ নানাবিধ উন্নয়ন কাজে বর্তমান পৌর প্রশাসক নিরলসভাবে কাজ করে চলছেন। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে সকল সমস্যা অচিরেই দূর হবে বলে তিনি মনে করেন।

এ বিষয়ে দাগনভুঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পৌরসভার প্রশাসক স,ম আজহারুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, দাগনভূঞা পৌরসভার নানাবিধ সমস্যা রয়েছে। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর এ বিষয়ে কাজ করছি। আসলে দীর্ঘ দিনের সমস্যা রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। স্থায়ী জায়গার অভাবে বর্জ্যের ডাম্পিং স্টেশন করা যায়নি। এ নিয়ে আমি বহু চেষ্টা চালিয়েছি। এ বিষয়ে প্রয়োজনে পৌরসভার পক্ষ থেকে জায়গা কিনে ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণের জন্য চেষ্টা করবো। এছাড়া আন্তরিকতার সাথে মাস্টার প্ল্যান নিয়ে সবার সহযোগিতা পেলে দাগনভূঞা পৌরসভার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব। তাছাড়া উন্নয়ন কাজে ধারাবাহিকতার অভাব রয়েছে। যতদিন দায়িত্বে থাকি পৌর নাগরিকদের জন্য আর্দশ পৌরসভা গড়ার কাজ অব্যাহত রাখবো।