জুলাই গণঅভ্যুত্থান

কুষ্টিয়ায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ১৬ জন, আহত ৫৮৩

পুলিশের ছোড়া গুলিতে শত শত ছাত্র-জনতা আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এ ঘটনায় পুলিশের গুলিতে ১৩ জন শহীদ হন। আহত হয় আরো ৫৮৩ জন।

আ ফ ম নুরুল কাদের, কুষ্টিয়া

Location :

Kushtia
ছাত্র-জনতার ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ
ছাত্র-জনতার ধাওয়া খেয়ে পালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ |নয়া দিগন্ত

৫ আগস্ট, গত বছরের এই দিনে কুষ্টিয়ায় পুলিশের গুলিতে ১৬ জন শাহাদতবরণ করেছিলেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে ছাত্র-জনতার বিজয়ের পর কুষ্টিয়া মডেল থানা পুলিশের নির্বিচারে গুলি বর্ষণে তাজা প্রাণ ঝড়ে পড়েছিল।

বিপ্লবে জয়ী হওয়ার জন্য যখন কুষ্টিয়ার মানুষেরা আনন্দ ও উল্লাসে মেতে থাকার কথা ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে সকল আনন্দ বিষাদে পরিণত হলো। জেনারেল হাসপাতালে নিহতদের লাশের স্তূপ পড়ে যায়। আহতদের সংখ্যা গুনে রাখার মত পরিস্থিতি ছিল না। পুরো শহর জুড়ে ছিল শোকে স্তব্ধ। এ সুযোগে কোনো কোনো মহল থানা এবং বিভিন্ন মানুষের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িতে হানা দিয়ে লুটপাট করতে ব্যস্ত দেখা গেছে। তবে ফ্যাসিষ্টদের বাড়িতে আক্রমণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনাটি সকলকে উপভোগ করতে দেখো গেছে।

৪ আগস্ট কুষ্টিয়ায় পুলিশের সাথে শহর এবং শহরতলীর বিভিন্ন পয়েন্টে আন্দোলনকারীদের সাথে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাঁধে। শহরের থানাপাড়া ছয় রাস্তার মোড়, মজমপুরগেট, থানা মোড়, চৌড়হাস, সাদ্দাম বাজার এলাকায় রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। চারিদিকে পুলিশের নির্বাচারের গুলি ও টিয়ার শেল নিক্ষেপের শব্দ পুরো শহরকে কাঁপিয়ে তুলেছিল। এদিন সারা দিনই থানাপাড়া ছয় রাস্তার মোড় ছিল আন্দোলনকারীদের দখলে। মজমপুর গেট পুলিশের দখলে থাকলেও জেলা স্কুল, সাদ্দাম বাজার ও চৌড়হাস ছিল আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার দখলে। দিন শেষে সড়কে ইটখোয়া ও পাথরের স্তূপ দেখে বুঝা যায় সারা দিনের তাণ্ডবে কেমন পরিস্থিতি হয়েছিল।

৫ আগস্ট সকাল ৯টার আগেই মজমপুর গেট, পাঁচ রাস্তা মোড় ও ছয় রাস্তা মোড় দখলে নেয় পুলিশ। এতে আন্দোলনকারীরা ত্রিমুখী লড়াইয়ে জড়িয়ে যায়। মজমপুর গেট থেকে সরাসরি পৌরসভার দিকে এবং সাদ্দাম বাজারের দিকে গুলিবর্ষণ করে পুলিশ। শহরের কয়েকটি পয়েন্টে পুলিশ নিজেদের দখলে নিলেও ওইসব পয়েন্টের চারপাশে ঘিরে রেখেছিল আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা। দুপুর ১২টার দিকে সেনাবাহিনী জেলা স্কুল ক্যাম্পাস থেকে নেমে এসে ছাত্র-জনতার সাথে হাত মিলিয়ে সকলকে শান্তিপূর্ণ অবস্থানের কথা বলে তারা পুলিশকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

এ সময় মজমপুরগেটে অবস্থানরত পুলিশ সদস্যরা জনতার উপর টিয়ারগ্যাস ও গুলি ছুড়তে ছুড়তে পুলিশ লাইনের দিকে চলে যায়। এ সময় সড়ক গুলোতে ছাত্র-জনতার সমাগম আরো বাড়তে থাকে। একপর্যায়ে দুপুর ২টার দিকে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবরে ছাত্র-জনতা কুষ্টিয়া মডেল থানার আশপাশে অবস্থান নেয়। এ সময় থানা থেকে বের হওয়ার মুহূর্তে পুলিশ নির্বিচারে গুলি করতে থাকে। পুলিশ গুলি করতে করতে মজমপুরগেট হয়ে পুলিশ লাইনে আশ্রয় নেয়। এ সময় পুলিশের ছোড়া গুলিতে শত শত ছাত্র-জনতা আহত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সাথে সাথে আহতদের এবং নিহতদের কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নেয়া হয়। এ ঘটনায় পুলিশের গুলিতে ১৩ জন শহীদ হন। আহত হয় আরো ৫৮৩ জন। আহত কয়েকজন সরকারি খরচে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ পেয়েছেন বলে জানা গেছে।

কুষ্টিয়ায় শহীদরা হলেন লাহিনী পাড়ার জুবায়ের আহমেদ ও জামাল উদ্দিন শেখ, কুমারখালীর সুলতানপুরের শায়খ আসহাবুল ইয়ামিন, চরজগন্নাথপুর গ্রামের সেলিম মণ্ডল ও আব্দুস সালাম, শিলাইদহ কসবার আলমগীর হোসেন, কুষ্টিয়া শহরের চরথানাপাড়ার আব্দুল্লাহ আল মুসতাকিন, চর আমলা পাড়ার সবুজ আলী, হাটশ হরিপুরের বাবলু ফারাজি, শালদহের আশরাফুল ইসলাম ও সুরুজ আলী, সদর উপজেলার দহকোলা গ্রামের উসামা, খোকসা জানিপুরের মারুফ হোসেন, খোকসা চাদটের মাহিম হোসেন, চর থানাপাড়ার ইউসুফ শেখ, ভেড়ামারা উপজেলার কলেজ পাড়ার মো: কবির।

এদিকে প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা গেছে, জেলায় ১৬ শহীদের পরিবারের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে প্রতি পরিবারকে ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র ও সম্মাননা স্মারক। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে প্রতি পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতি পরিবারকে দু’লাখ টাকা, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশে (বিজিবি) পাঁচ শহীদ পরিববার এবং পাঁচ আহত পরিবারকে চার লাখ ২৫ হাজার টাকা প্রদান করে।

এছাড়া আমরা বিএনপি পরিবারের পক্ষ থেকে প্রতি পরিবারকে ৫০ হাজার করে টাকা, জেলা জামায়াতের উদ্যোগে প্রতি শহীদ পরিবারের জন্য দু’লাখ টাকা করে এবং মহিলা অধিদফতরের পক্ষ থেকে সম্মাননা স্মারক প্রদান করা হয়।