এক সময়ের ব্যস্ততা, অপেক্ষা আর ভালোবাসার কেন্দ্র ছিল টিঅ্যান্ডটি অফিসগুলো। মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার একমাত্র প্রাণকেন্দ্র ছিল। মানুষ লাইন ধরে দাঁড়িয়ে প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর শুনতে ভিড় করত। ভবনগুলোর চারপাশে ছিল কোলাহল, ছিল আবেগের ভিড়। আজ সেসব শুধুই স্মৃতি।
পটুয়াখালী জেলার রাঙ্গাবালীর জরাজীর্ণ টিঅ্যান্ডটি অফিস ভবনের দরজা-জানালা ভাঙ্গা, ছাদ থেকে পলেস্তার খসে পড়ছে, ভেতরে জমে আছে ধুলোবালু আর আবর্জনা। অফিস ভবনে গেলে মনে হয় যেন এক ‘ভূতুড়ে ভবন’। স্থানীয়রা জানায়, রাঙ্গাবালীর টিঅ্যান্ডটি অফিসটি ১৯৮০ সালের দিকে নির্মিত হয়েছিল।
আজ শনিবার (১৭ মে), বিশ্ব টেলিযোগাযোগ দিবস। যেখানে বিশ্বের নানা প্রান্তে উদযাপন হচ্ছে উন্নত সংযোগের গল্প, সেখানে রাঙ্গাবালীর এই ভবনটি যেন দাঁড়িয়ে আছে অবহেলা আর বিস্মৃতির প্রতীক হয়ে। ২০-২৫ বছর আগেও সাগরপাড়ের দ্বীপাঞ্চল রাঙ্গাবালীতে মোবাইল ফোনের ব্যবহার তেমন ছিল না। টিঅ্যান্ডটি ছাড়া বাণিজ্যিকভাবে দু’একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান সীমিত পরিসরে টেলিযোগাযোগ সেবা দিত। তবে সেই ফোনালাপ ছিল ব্যয়বহুল। তখনকার দিনে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল এই টিঅ্যান্ডটি অফিসটি। ফোন করতে আসা মানুষজনের দীর্ঘ লাইন ছিল নিত্যদিনের চিত্র।
উপজেলার বাহেরচর বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, ‘এই অফিসের মাধ্যমেই দূর-দূরান্তের আত্মীয়-স্বজনের সাথে যোগাযোগ হতো। একটা টেলিফোনের অপেক্ষায় কত সময় যে অপেক্ষায় থাকতাম। কখনো ভালো খবর, কখনো কষ্টের কথা। সুখ-দুখের খবর জানার ভরসাই ছিল এই অফিস ভবনটি। সেসব এখন শুধুই অতীত।’
বাজারের আরেক প্রবীণ আব্দুর রব বলেন, ‘টিঅ্যান্ডটি অফিসের টেলিফোনের অপেক্ষায় থাকতাম, কখন ঢাকা কিংবা বিদেশ থেকে স্বজনরা ফোন দেবে। টিঅ্যান্ডটি অফিস থেকে খবর আসত, আপনার ফোন এসেছে। পরিবারের লোকজন নিয়ে ছুটে যেতাম। সে কী অনুভূতি, যা বলে বোঝানো যায় না।’
সরেজমিন দেখা গেছে, ভবনের ভেতরটা এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। ভাঙ্গা দরজা-জানালা সবই পড়ে আছে নীরবে। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখা যায়, জানালার ধারে জমে আছে মাকড়সার জাল। অনেকেই বলছে, সন্ধ্যার পর একা এই ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে গা ছমছম করে।
স্থানীয় তরুণ নওশাদ বলে, ‘এটা এখন ভূতুড়ে জায়গা। ছোটবেলায় দেখতাম মানুষ ফোন করতে আসত। এখন ভাবতেই অবাক লাগে এটা এক সময়ে যোগাযোগ কেন্দ্র ছিল।’
রাঙ্গাবালী প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এম সোহেল বলেন, ভবনটি সংস্কার করে কোনো সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা যায়। এই যেমন পাঠাগার, কমিউনিটি সেন্টার বা যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
এই উপজেলার মানুষের জীবনমান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা একটি বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা শাহিন আহমেদ বলেন, ‘আমরা উচ্চগতির ইন্টারনেট, ভিডিও কল বা ফাইভ-জির যুগে প্রবেশ করছি। মানুষ এখন হোয়াটসঅ্যাপ, ম্যাসেঞ্জারসহ বিভিন্ন মাধ্যমে অডিও-ভিডিও কলে কথা বলে। তাই বলে কি যোগাযোগের এই শিকড়কে অবহেলায় ভুলে যাওয়া যায়? আধুনিকতায় কেন হারিয়ে যাবে টিঅ্যান্ডটি? আমরা চাই, আধুনিকতার ছোঁয়া টিঅ্যান্ডটিতেও পড়ুক।’
বাংলাদেশে টিঅ্যান্ডটি সরকারের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি প্রতিষ্ঠান। এটি বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) মাধ্যমে পরিচালিত হতো।