গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে মিড ডে মিল কর্মসূচিতে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের নির্ধারিত খাদ্যতালিকা অনুযায়ী সরবরাহ করা হচ্ছে না খাবার। গত ২৫ দিনের মধ্যে মাত্র দুই দিন শিক্ষার্থীরা পেয়েছে তরল দুধ। দুধের পাশাপাশি রুটিন অনুযায়ী ডিম, বনরুটি, বিস্কুট, কলা ও মৌসুমি ফল বিতরণের কথা থাকলেও এই এলাকার শিক্ষার্থীদের মাঝে এসব সরবরাহ করা হয়নি একবারও।
এদিকে মিড ডে মিল বা স্কুল ফিডিং কর্মসূচি বাস্তবায়ন সম্পর্কে কোনো তথ্য জানেন না ইউএনও এবং শিক্ষা কর্মকর্তাসহ শিক্ষকেরা।
পুষ্টি নিশ্চিত ও ঝরে পড়ার হার কমাতে সরকারিভাবে গত ১৫ নভেম্বর দেশের ১৫৫টি উপজেলায় ৩১ লাখ শিশুদের জন্য ‘মিড ডে মিল’ বা স্কুল ফিডিং কার্যক্রমের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়।
এই তালিকায় থাকা গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া উপজেলায় এই কার্যক্রম শুরু হয় ১৭ নভেম্বর। এরমধ্যে শিক্ষার্থীদের মাঝে দুইদিন তরল দুধ বিতরণ করা হয়। বাকি কোনো উপকরণ বিতরণ করা হয়নি।
সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো কর্মসূচির বাস্তবায়ন সম্পর্কে কোনো তথ্য জানেন না ইউএনও, শিক্ষা কর্মকর্তা ও কোনো বিদ্যালয়ের শিক্ষক।
প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী কোটালীপাড়া উপজেলার ১৮৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট ২০ হাজার ৫ শ’ জন শিক্ষার্থীর জন্য এই ‘মিড ডে মিল’ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করার কথা রয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের নির্ধারিত খাদ্যতালিকা অনুযায়ী স্কুল চলার সময় সপ্তাহে পাঁচ দিন শিক্ষার্থীদের রোববার, মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার বনরুটি ও সিদ্ধ ডিম; সোমবার বনরুটি ও ইউএইচটি দুধ; বুধবার ফর্টিফায়েড বিস্কুট ও স্থানীয় মৌসুমি ফল সরবরাহ করার কথা। প্রতিটি বনরুটির ওজন নির্ধারণ করা হয়েছে ১২০ গ্রাম, প্রতিটি ডিম ৬০ গ্রাম, দুধ ২০০ গ্রাম, বিস্কুট ৭৫ গ্রাম ও ফল ১০০ গ্রাম। অথচ গত ১৭ নভেম্বর থেকে শুরু হওয়া এ কর্মসূচি কোটালীপাড়ায় কার্যত শুধু নামেই চলছে।
অভিযোগ উঠেছে, কোটালীপাড়া উপজেলায় দুই দিন প্যাকেট তরল দুধ দিয়েই প্রকল্পের বাস্তবায়ন দেখানো হচ্ছে। যা চাহিদার তুলনায় অত্যন্ত অপ্রতুল।
বুধবার (১০ ডিসেম্বর) সরেজমিনে কোটালীপাড়া উপজেলার ৬৮ নম্বর তারাশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, নভেম্বর মাসের ১৭ তারিখ থেকে ডিসেম্বর মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত, ক্লাস চলার সময় ১৮ দিনের মধ্যে ছাত্র প্রতি ১ প্যাকেট করে দুইদিন বিতরণের জন্য ৪শ’ ৫৯ প্যাকেট প্রাণ কোম্পানির দুধ সরবরাহ পেয়েছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
তারাশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক অশোক অধিকারী বলেন, ‘১৭ নভেম্বর হঠাৎ করে প্রাণ কোম্পানির প্রতিনিধিরা এসে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ২শ’ গ্রামের ১ প্যাকেট করে দুইদিন বিতরণের জন্য ৪ শ’ ৫৯ প্যাকেট তরল দুধ দিয়ে যায়। এছাড়া অন্য কোনো উপকরণ দেয়া হয়নি।
তারাশী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী অভিভাবক নুসরাত জাহান বলেন, ‘পত্রিকার মাধ্যমে প্রাথমিকে মিড ডে মিল সর্ম্পকে আমরা জানতে পারি যে, প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে রোববার ১২০ গ্রাম ওজনের বনরুটি এবং সিদ্ধ ডিম, সোমবারে বনরুটি এবং ২০০ গ্রাম ইউএইচটি দুধ, মঙ্গলবারে ৭৫ গ্রাম ওজনের ফর্টিফাইড বিস্কুট এবং কলা বা স্থানীয় মৌসুমি ফল, বুধবার এবং বৃহস্পতিবারে বনরুটি এবং সিদ্ধ ডিম প্রদান করা হবে। তবে আমার মেয়ে গত এক মাসে দুইদিন ১ প্যাকেট করে দুধ পেয়েছে। বাকি উপকরণ না দেয়ায় কোমলমতি শিক্ষার্থীরা তাদের নির্ধারিত ‘মিড ডে মিল’ বা দুপুরের পুষ্টিকর খাবার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ভেস্তে যেতে বসেছে সরকারের এ মহৎ উদ্যোগ।
৬ নম্বর ঘাঘরকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নমিতা মন্ডল জানান, ১৮ নভেম্বর থেকে মিড ডে মিল কর্মসূচি শুরু হলেও আমরা মাত্র একদিন শুধু তরল দুধ পেয়েছি প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে দুইদিন হিসেবে বিতরণের জন্য। তবে কে বা কারা এসব দুধ সরবরাহ করছে সেটা আমরা জানি না।
উপজেলার ঘাঘর কান্দা, কয়খা, বাগান উত্তরপাড়াসহ বেশ কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ঘুরে একই চিত্র পাওয়া যায়।
উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শেখর রঞ্জন বলেন, ‘ঢাকায় নিয়ে আমাদের একদিন ওরিয়েন্টেশন ক্লাস হয়েছে মিড ডে মিলের বিষয়ে। তখন বলা হয়, উপজেলায় প্রাথমিকের সকল শিক্ষার্থী সপ্তাহে পাঁচদিন দুধ, ডিম, বনরুটি, বিস্কুট, কলা ও মৌসুমি ফল পাবে ‘মিড ডে মিল’ কর্মসূচির আওতায়।
বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকেরা জানিয়েছেন, তারা শুধু নভেম্বর মাসে ২ দিনের জন্য তরল দুধ পেয়েছেন। ঠিকাদারের লোকজন আমাদের সাথে কোন সমন্বয় করেনি।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজলা মিড ডে মিল কর্মসূচি কমিটির সভাপতি সাগুফতা হক বলেন, ‘মিড ডে মিল কর্মসূচির বাস্তবায়নের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই। এ ব্যাপারে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো কিছু জানানো হয়নি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোছা: জোৎস্না খাতুন বলেন, ‘গতমাসে সারাদেশের ১৫৫টি উপজেলায় মিড ডে মিল চালু করেছে সরকার। গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া ও কাশিয়ানী উপজেলা এই কর্মসূচির আওতায় রয়েছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উপজেলার শিক্ষা অফিসারেরা ভালো বলতে পারবেন। নির্ধারিত খাদ্য তালিকা অনুযায়ি কেন সরবরাহ করা হয় নাই এই বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হবে।



