শহীদ রা‌কি‌বের বাবা

কারো বাবা-মায়ের কোল যেন পুলিশের গুলিতে খালি না হয়

‘কত আবেগ-আপ্লুত ছিল সে। সব স্বপ্ন একটি গুলিতে শেষ হয়ে গেল। সন্তান তার বাবার মুখ দেখতে পারল না।’

মো: সাজ্জাতুল ইসলাম, ময়মনসিংহ

Location :

Mymensingh
শহীদ হন হাফেজ নু‌রে আলম সিদ্দিকী রা‌কিব (২১)
শহীদ হন হাফেজ নু‌রে আলম সিদ্দিকী রা‌কিব (২১) |নয়া দিগন্ত

বাবার স্বপ্ন ছিল কুরআনে হাফেজ একমাত্র ছেলে অন্তত মৃত্যুর পর তার জানাযা পড়াবে! কিন্তু উল্টো বাবার সেই স্বপ্ন দুমড়ে-মুচড়ে গিয়ে বাবার কাঁধে সন্তানকে বয়ে আনতে হলো, এমনটি বলে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললেন ছেলে হারানোর শোকে কাতর আব্দুল হা‌লিম। তি‌নি ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার দাওগাঁও তালিমুল কুরআন মহিলা মাদরাসার পরিচালক ও শিক্ষক।

তিনি কাঁদতে কাঁদতে ব‌লেন, ‘আর কারো বাবা-মায়ের কোল যেন পুলিশের গুলিতে খালি না হয়। ছেলের কাঁধে চড়ে কবরে যাবো। কিন্তু বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ যে কত কষ্টের এটা আমার মতো হতভাগ্য ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারবে না।

রোববার (৩ জুলাই) দুপু‌রে আব্দুল হা‌লিম দৈনিক নয়া দিগন্ত‌কে জানান, আমার হাফেজ ছেলের স্বপ্ন ছিলো একটা মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করবে। সেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়াশোনায় মশগুল থাকবে, দ্বীনের দাওয়াতি কাজ ছড়িয়ে দিবে। কিন্তু এক গু‌লিতেই তছনছ হয়ে গেছে হা‌ফেজ নু‌রে আলম সি‌দ্দিকী রা‌কি‌বের স্বপ্ন। রা‌কিব শহীদ হওয়ার পর বাড়িতে এসে অনেক মানুষজন খোঁজ-খবর নিল। কিছু সহায়তাও করল। এখন তো আর কেউ আসে না।

জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত বছরের ২০ জুলাই ফ্যাসিস্ট সরকারের পুলিশের গুলিতে শহীদ হন হাফেজ নু‌রে আলম সিদ্দিকী রা‌কিব (২১)। চার ভাইবোনের মধ্যে রাকিব ছিলেন তার একমাত্র ছেলে। তিন মেয়ের মধ্যে দুইজনকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে মাদরাসায় পড়ছে। গত বছর ১২ জানুয়ারি ছেলেকে বিয়ে করান ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের পলাশকান্দা গ্রামে। ছেলের বউ সাদিয়া আক্তার মাদরাসা শিক্ষার্থী ছি‌লেন। রা‌কিব মারা যাওয়ার সময় তি‌নি চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছি‌লেন। এখন তিনি এক মেয়ে সন্তান জন্ম দি‌য়ে‌ছেন। স্ত্রী সা‌দিয়ার শারীরিক অসুস্থতার কারণে ২০ জুলাই সকালে স্ত্রীর জন্য ওষুধ আনতে গৌরীপুর উপজেলার কলতাপাড়ায় যান রাকিব।

শহীদ রা‌কি‌বের বাবা আব্দুল হা‌লিম জানান, শুনেছি ওইদিন কলতাপাড়ায় গোলোযোগ দেখে রাকিব নিজের মোবাইল দিয়ে ভিডিও করছিল। তখনই নাকি গুলিবিদ্ধ হয়। ওর তো কোনো দোষ ছিল না। ও তো রাজনীতিও করত না। তাহলে কেন গুলি করল তাকে।

তিনি জানান, রাকিবের কণ্ঠস্বর খুবই ভালো ছিল। ভিডিও করা তার শখ ছিল। তার ফেসবুক আইডি আছে, সেখানে গজল গেয়ে আপলোড করত। অনেক আশা ছিল রাকিব সংসারের হাল ধরবে। বংশের বাতি হয়ে আলোকিত করবে। এখন তো সবই শেষ হয়ে গেল। বংশের বাতিটাই তো নিভে গেল। রা‌কিব‌কে হারিয়ে এখন বাকরুদ্ধ তার পরিবার। বুকের ধন প্রিয় সন্তানকে হারিয়ে মায়ের কান্না যেন থামছেই না। সন্তান হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত, বিচারসহ সরকারি সহায়তা চান পরিবার।

রা‌কি‌বের বিষয়ে জানতে চাইলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে আব্দুল হালিম বলেন, ‘আমার মতো আর কারো সন্তান যেন পুলিশের গুলিতে মারা না যায়। আমাকে সব দিলেও আমি আমার সন্তানকে আর ফিরে পাব না।’

চোখের পানি মুছতে মুছতে ‌তি‌নি আরো বলেন, ‘ইচ্ছে ছিল একমাত্র ছেলে বড় আলেম হবে। আমাদের স্বপ্ন পূরণ হলো না। আমার ছেলে হত্যার বিচার আমি শুধু আল্লাহর কাছে চাই। আমার ছেলে হত্যার বিচার যেন আল্লাহ করেন।’

স্বজনরা জানান, ওইদিনই গভীর রাতে রা‌কি‌বের লাশ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। রা‌তেই ত‌ড়িঘ‌ড়ি ক‌রে পা‌রিবারিক কবরস্থানে লাশ দাফন করা হয়।

এদিকে রা‌কিব শহীদ হওয়ার হওয়ার ৬ মাস পর গত ১৯ জানুয়া‌রি ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মেয়ে সন্তান জন্ম দেন তার স্ত্রী সাদিয়া।

সাদিয়া আরো জানান, তার স্বামী সন্তানকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখতেন। ও আসবে, ওর জন্য ঘর সাজাতে হবে। ও আমাকে স্পর্শ করে সন্তানের ছোঁয়া অনুভব করত। কত আবেগ-আপ্লুত ছিল সে। সব স্বপ্ন একটি গুলিতে শেষ হয়ে গেল। সন্তান তার বাবার মুখ দেখতে পারল না। এই বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

তি‌নি বলেন, ‘আমার সন্তানের কী দোষ ছিল, সে কেন এতিম হলো। ওইদিন তার মেয়ে সন্তান হওয়ার খবরে হাসপাতালে ছুটে যান রাকিবের বাবা।’

তিনি বলেন, ‘আমি দাদু ভাইটাকে কোলে নিয়েছি। ও বাবা হারা, আমি সন্তান হারা। আল্লাহ যেন ওকে হেফাজত করেন।’

রাকিবের মা মোছা: নুরুন নাহার জানান, রাকিব শহিদ হওয়ার পর থে‌কে স্বামীর শোকে পাথর হয়ে গেছেন সাদিয়া। কাঁদতে কাঁদতে ওর চোখের পানিও শুকিয়ে গেছে। সারাদিনই নির্বাক থাকে। ওর মুখের দিকে তাকানোই যায় না। দেখলেই কলিজাটা খান খান হয়ে যায়। এখন শিশু কন‌্যার মুখের দি‌কে তা‌কি‌য়ে সা‌দিয়া নি‌জের স্বাভা‌বিক রাখ‌ছেন।