ববি শিক্ষার্থীদের অভিমত

‘আমরা শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পারিনি’

‘১৯৭১ এ পাকিস্তানি নিপীড়ন কিংবা এরশাদের স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে যেমন লড়াই হয়েছে তেমনি চব্বিশ সালেও ফ্যাসিস্ট হাসিনার দীর্ঘ নিপীড়নের বিরুদ্ধে এই লড়াই হয়েছে।’

মেহরাব হোসেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়

Location :

Barishal
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় |নয়া দিগন্ত

২০২৪ সালের জুলাই মাস বাংলাদেশের ইতিহাসের এক নাটকীয় অধ্যায়। কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলন দ্রুতই রূপ নেয় ফ্যাসিবাদবিরোধী গণঅভ্যুত্থানে। এই অভ্যুত্থান দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে জমা হওয়া ক্ষোভ, হতাশা আর বঞ্চনার বহিঃপ্রকাশ। এক বছর পর ২০২৫ সালের আগস্টে দাঁড়িয়ে সেই আন্দোলনের অন্যতম কেন্দ্র বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ফিরে দেখছেন কতটা বদলেছে বাস্তবতা? কতটা পূরণ হয়েছে তাদের স্বপ্ন?

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সুজয় শুভ এই আন্দোলনকে দেখেছেন বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটি জাতির চিরায়ত সংগ্রামের অংশ হিসেবে। তিনি বলেন, ১৯৭১ এ পাকিস্তানি নিপীড়ন কিংবা এরশাদের স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে যেমন লড়াই হয়েছে তেমনি ফ্যাসিস্ট হাসিনার দীর্ঘ নিপীড়নের বিরুদ্ধে হয়েছে এই লড়াই।

জুলাই অভ্যুত্থানকে তিনি জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, এই ঘটনার মধ্য দিয়ে আমাদের সমস্ত প্রত্যাশা পূরণ হবে এমন না। তবে দুঃখজনক বিষয় হলো আমরা শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পারিনি। বৈষম্যহীন দেশ প্রতিষ্ঠায় একাগ্রতার অভাব রয়েছে।

যে স্বপ্ন নিয়ে রাজপথে নেমেছিলাম তার বাস্তবায়ন দেখতে চাই

আন্দোলনের সম্মুখ সারির যোদ্ধা সাজ্জাদ হোসেনের মূল লক্ষ্য ছিল একটি দুর্নীতিমুক্ত ও সুশাসিত দেশ গড়া। কিন্তু এক বছর পরেও দৃশ্যমান পরিবর্তন দেখতে না পেয়ে তিনি হতাশ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে শুরু করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে আজও রয়ে গেছে সেই পুরনো জীর্ণতা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতার অভাব, প্রশাসনে দীর্ঘসূত্রিতা এবং দুর্নীতির অভিযোগ তাঁকে হতাশ করে। সরকারের কাছে দাবি জানান যেন জুলাই আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি সম্মান জানিয়ে শিক্ষা খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হয়।

তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করেছিলাম আমাদের আত্মত্যাগ একটি নতুন ভোরের সূচনা করবে যেখানে মেধা ও যোগ্যতাই হবে একমাত্র মাপকাঠি।

এটি ছিল জমে থাকা ক্ষোভের গণ-বিস্ফোরণ

আন্দোলনে আহত আরেক সংগঠক মোকাব্বেল শেখ বলেন, সফল জুলাই অভ্যুত্থান কোনো পরিকল্পিত বিপ্লব নয়। এটি দীর্ঘ ফ্যাসিবাদী শাসনের ফলে জমা হওয়া একটি গণ-বিস্ফোরণ।

তাঁর প্রত্যাশা ছিল এই আন্দোলন বাংলাদেশে একটি স্থায়ী কাঠামোগত পরিবর্তন নিয়ে আসবে। স্বাধীনতার পর যা কখনোই আসেনি। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেখতে পাননি আশানুরূপ পরিবর্তন। অব্যবস্থাপনা, বৈষম্য আর দুর্নীতি এখনো অনেকাংশে রয়ে গেছে। তাঁর আশা এই বিপ্লব একদিন শহীদদের আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।

আমার শরীরে ৫১টি স্প্লিন্টার লেগেছিল

জুলাই বিপ্লবে গুলিবিদ্ধ হাসনাত আবুল আলা এই আন্দোলনকে ‘স্বাধিকার ফিরে পাওয়ার আপসহীন সংগ্রাম’ হিসেবে বর্ণনা করেন। তার মতে এই বিপ্লব ছিলো ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনগণের তীব্র ক্ষোভের প্রকাশ।

তিনি স্মরণ করেন, ১৬ জুলাইয়ের সেই বিভীষিকাময় দিন যেদিন আবু সাঈদ, শান্ত, ওয়াসিমসহ ছয়জন শহীদ হন। ৪ আগস্ট বরিশাল হাতেম আলী কলেজের সামনে পুলিশের স্প্লিন্টার হামলায় তার মাথায়, বুকে, হাতে ও চোখে মোট ৫১টি স্প্লিন্টার লাগে। সেই যন্ত্রণা ও ত্যাগের পর ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়।

এত আত্মত্যাগের পরও তিনি হতাশ যে জুলাই ঘোষণা ও সনদ মেলেনি। গণহত্যার দায়ে জড়িতদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন অনিশ্চিত।

তিনি বলেন, এখনো নির্বিচারে মানুষ খুন হয়। দুর্নীতি ও চাঁদাবাজি মানুষকে অতিষ্ঠ করে রাখছে। তবে অসংখ্য অসংগতির মাঝেও তিনি একটি সুখী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যাশা করেন। যেখানে থাকবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রক্ষিত হবে শহীদদের চেতনা ।

জুলাই আন্দোলনের এক বছর পূর্তিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই ভাবনাগুলো স্পষ্ট করে যে, এটি কেবল একটি কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছিল না বরং ছিল একটি জাতির অধিকার ও আত্মমর্যাদা পুনর্জাগরণের লড়াই। সব দাবি এখনো পূরণ না হলেও এ আন্দোলন থেকে জন্ম নিয়েছে প্রতিরোধের এক নতুন ভাষা। ভবিষ্যতেও এই জুলাইয়ের স্বপ্ন ও প্রেরণা সহজে থামার নয়।