ময়মন‌সিং‌হে মাছ উৎপাদ‌নে রেকর্ড

২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে ময়মনসিংহ মাছ উৎপাদনে দেশের শীর্ষ স্থান ধরে রেখে চার লাখ ১৮ হাজার টন উৎপাদন করেছে

মো: সাজ্জাতুল ইসলাম, ময়মনসিংহ

Location :

Mymensingh
নয়া দিগন্ত

ময়মনসিংহ দেশে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছ‌রে মাছ উৎপাদনে আবারো শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। এবার জেলায় মাছ উৎপাদনে এক নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। জেলা মৎস্য অফিসারের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর মোট চার লাখ ১৮ হাজার ৬৪৫ টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে। যার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় ১২ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এটি গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এই বিপুল পরিমাণ উৎপাদন এসেছে জেলার মোট ৩৩ হাজার ৪৬০ হেক্টর জলমহল থেকে। মাছ চাষ এখন জেলার সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক উৎ‌সে পরিণত হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের মধ্যে ময়মনসিংহে সবচেয়ে বেশি মাছ উৎপাদন হচ্ছে। এ জেলা থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাকে রুই, কাতলা, মৃগেল, কালিবাউশ, পাঙাশ, তেলাপিয়া, পাবদা, শিং, গুলশা, মাগুরসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছ যাচ্ছে রাজধানীসহ সারাদেশে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ত্রিশাল-ভালুকা, ময়মনসিংহ-শেরপুর ও কিশোরগঞ্জ মহাসড়কের দু’পাশে মাইলের পর মাইল চোখে পড়বে হাজার হাজার বাণিজ্যিক মাছের খামার।

মূলত আশির দশকের শেষ দিকে শুরু হওয়া রুপালি বিপ্লব পূর্ণতা পায় নব্বই দশকে। এরপর ২০১০ সাল থেকে টানা মাছ চাষে প্রথম ময়মনসিংহ। দেশে মোট উৎপাদনের ১২ শতাংশ মাছ উৎপাদন হয় এ জেলায়। প্রায় তিন লাখ পুকুর ও খামার রয়েছে এখানে। এর মধ্যে প্রায় এক লাখেরও বেশি পুকুর ও খামারে বাণিজ্যিক উৎপাদন হচ্ছে। সব মিলে মৎস্য চাষি প্রায় এক লাখ ২০ হাজার।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তার তথ্য মতে, মাছ উৎপাদনে ময়মনসিংহ জেলায় প্রথম স্থানে আছে ভালুকা। ভালুকায় তিন হাজার ৫৯৬ হেক্টর আয়তনের পুকুরে ৮৩ হাজার ৫৫৩ টন মাছ উৎপাদন হয়। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ত্রিশাল উপজেলা। ত্রিশালে তিন হাজার ৬৮৭ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় ৭২ হাজার ৮৮ টন। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ময়মনসিংহ সদর উপজেলা। দুই হাজার ৫০০ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় বছরে প্রায় ৪০ হাজার টন। তাছাড়াও গৌরীপুর উপজেলায় এক হাজার ৬৮০ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় ১৬ হাজার ৫০০ টন। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় দুই হাজার ২৭০ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় ২৪ হাজার টন। গফরগাঁও উপজেলায় দুই হাজার ৫৮০ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় ১৮ হাজার ৭৮৪ টন। তারাকান্দা উপজেলায় দুই হাজার ৪৯৫ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় ২৯ হাজার টন। ধোবাউড়া উপজেলায় এক হাজার ১৪৮ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় সাত হাজার ৪৩১ টন। ফুলপুর উপজেলায় দুই হাজার ৩০২ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় ২৩ হাজার ৫৬৪ টন। ফুলবাড়িয়া উপজেলায় দুই হাজার ৮৪০ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় ২৪ হাজার ৩২৫ টন। ফুলপুর উপজেলায় দুই হাজার ৩০২ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় ২৩ হাজার ৫৬৪ টন। হালুয়াঘাট উপজেলায় এক হাজার ৪৩০ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় আট হাজার ৭০০ টন। নান্দাইল উপজেলায় চার হাজার ১২৮ হেক্টর আয়তনের পুকুরে মাছের উৎপাদন হয় ২৮ হাজার ৬৭৩ টন।

এদি‌কে মাছ চাষিরা অভি‌যোগ করেন, উৎপাদিত মাছ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে না পারা এবং অনুন্নত বাজার ব্যবস্থার কারণে অনেক সময় তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পান না।

এ বছর জেলায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছের আনুমানিক বাজার মূল্য হলো রুই ৩০০-৪০০ টাকা কেজি, কাতলা ৩৫০-৪০০ টাকা কেজি, মৃগেল ২৫০-৩০০ টাকা কেজি, পাঙ্গাস ১৮০-২২০ টাকা কেজি, শিং ৩৫০-৪০০ টাকা কেজি, পাবদা ৪০০-৪৫০ টাকা কেজি, গোলশা ৫০০-৫৫০ টাকা কেজি এবং কৈ ২২০-২৫০ টাকা কেজি।

বাজার মূল্যের কম-বেশি হওয়ায় তাদের মুনাফা কমে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন অনেক চাষি।

মাছ চাষিরা আরো জানান, উৎপাদন বাড়লেও তা‌দের মুখে হাসি নেই। মা‌ছের খাদ্যের উচ্চ মূল্য, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর উচ্চ সুদের হার এবং বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ বিল আদায় হওয়ায় তাদের উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। এছাড়াও, আকস্মিক বন্যা এবং মাছের রোগবালাইয়ের কারণে প্রায়ই বড় ক্ষতির মুখে পড়তে হয় তাদের। মাটি, পানি পরীক্ষা ও রোগ নির্ণয়ের জন্য পরীক্ষাগারের অভাবও চাষিদের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন জানান, বেশিভাগ ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মাছ চাষ করা হয় এবং মৎস্য অধিদফতর এক্ষেত্রে চাষিদের প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করে থাকে। যদি কোনো চাষি পুকুরে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে, মৎস্য অধিদফতর সেক্ষেত্রে মৎস্য পরিদর্শন ও মান নিয়ন্ত্রণ আইন ২০২০ অনুযায়ী অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে থাকে। এছাড়াও, গুণগত ও নিরাপদ মৎস্য খাদ্য নিশ্চিত করতে নিয়মিত নমুনা পরীক্ষা করা হয় এবং খাদ্যে ভেজাল পাওয়া গেলে মৎস্য ও পশুখাদ্য আইন ২০২০ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়।

তি‌নি আরো জানান, প্রান্তিক পর্যায়ে চাষিদের অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। পুকুরে পানি দেয়ার জন্য তাদের বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ বিল দিতে হয়। মাছ চাষিদের জন্য বিদ্যুৎ বিল কৃষকদের মতো সহনীয় পর্যায়ে রাখা উচিত। তাছাড়া মাছের খাবারের উচ্চ মূল্যের কারণে অনেক কৃষক লাভ করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে চাষিরা যাতে মাছের ন্যায্য মূল্য পায় সেদিকে সরকারের নজর দেয়া উচিত।

তিনি জানান, মাছ চাষিদের মূল্যায়ণ করলে উৎপাদন আরো অনেক বাড়ানো যেত। সেক্ষেত্রে আমাদের জিডিপি মাছের উপর ভিত্তি করে আরো অনেক বেড়ে যেত। সে জন্য মৎস্য বিভাগ জনবল বাড়ানো দরকার। সে সাথে গবেষণাগার, পরীক্ষাগার, হিমাগারসহ আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করতে পারলে উৎপাদন কয়েক গুণ বেড়ে যাবে।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো: মশিউর রহমান জানান, মা‌ছের খাবার তৈরির জন্য যে উপাদানগুলো বিদেশ থেকে আনতে হয় সেগুলো অনেক দামি। এগুলো দেশে উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর মাছের উৎপাদন বাড়াতে হলে আমাদের দেশের প্রত্যেকটি জলাশয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা দরকার। সেজন্য বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে উন্নত মানের মৎস্য বীজ ও পোনা সরবরাহ করা হয়। মাছের প্রকৃত দাম পাওয়ার জন্য বাজারজাতকরণের উপর গুরুত্ব দেন এ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা।

তিনি আরো জানান, রেডি টু কুক বা রেডি ফুডের ব্যবস্থা করতে পারলে মাছের চাহিদা বেড়ে যাবে। পাশাপাশি মাছ বিদেশে রফতানি করতে পারলে চাষিরা উপকৃত হবে।

ময়মনসিংহ বিভাগীয় মৎস্য অফিসের পরিচালক নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস ‌দৈ‌নিক নয়‌া দিগন্ত‌কে জানান, ময়মনসিংহের এ সফলতার পেছনে রয়েছে বিশাল জলসম্পদ আর চাষীদের একাগ্রতা। এখানকার প্রকৃতি ও ভৌগোলিক অবস্থান মাছ চাষের জন্য অত্যন্ত অনুকূল।

নৃপেন্দ্র নাথ বিশ্বাস আরো বলেন, ‘ভবিষ্যতে আমাদের মূল লক্ষ্য হলো একটি টেকসই বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা। আমরা সরাসরি চাষি থেকে ভোক্তার কাছে মাছ পৌঁছানোর জন্য একটি কার্যকর সরবরাহ ব্যবস্থা তৈরির পরিকল্পনা করছি। এর ফলে চাষিরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মূল্য পাবেন। একই সাথে, আমরা আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের মাছ রফতানির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য কাজ করব।’