নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে নির্মাণ শ্রমিকরা

একদিকে নতুন ট্রলার তৈরির কাজ চলছে, একইসাথে পুরোদমে চলছে পুরাতন ট্রলার মেরামতের কাজ। এসব ট্রলার মেরামতের কাজে নিয়োজিত রয়েছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় শতাধিক কাঠমিস্ত্রি।

হুমায়ুন কবীর, কলাপাড়া (পটুয়াখালী)

Location :

Patuakhali
নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে শ্রমিকরা
নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছে শ্রমিকরা |নয়া দিগন্ত

সাগর মোহনা ও গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারের প্রধান বাহন হচ্ছে ট্রলার। সাগরে যাত্রার প্রধান বাহনটি সুসজ্জিত করার জন্য সবাই আসেন ডক ইয়ার্ডে। ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ এই তিন মাসে ডক ইয়ার্ডে থাকে প্রাণচাঞ্চল্য। ট্রলার ও নৌকা নির্মাণ শ্রমিকরা কেউ ট্রলারের গুঁড়া লাগাচ্ছেন, কেউ কাঠ মসৃণ করছেন, কেউ কাঠ জোড়া লাগানোর কাজ করছেন। মিস্ত্রিদের হাতুড়-বাটালের আওয়াজে মুখরিত হচ্ছে এসব জেলেপল্লী।

একদিকে নতুন ট্রলার তৈরির কাজ চলছে, একইসাথে পুরোদমে চলছে পুরাতন ট্রলার মেরামতের কাজ। এসব ট্রলার মেরামতের কাজে নিয়োজিত রয়েছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় শতাধিক কাঠমিস্ত্রি।

বর্ষার আগমনে গভীর সমুদ্রে মাছ শিকারে বড় প্রস্তুতি নিচ্ছে কুয়াকাটা জেলার মৎস্যজীবীরা। এতে নতুন ট্রলার তৈরি ও পুরাতন ট্রলার মেরামত করে ব্যস্ত সময় পার করছেন কাঠমিস্ত্রিরা। নৌকা তৈরিতে সময় কম লাগলেও একটি নতুন ট্রলার তৈরি করতে দুই মাসের মতো সময় লাগে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ আর ব্যস্ততা ঘিরে থাকে জেলেপল্লীতে। এতে উচ্ছ্বসিত জেলেপল্লীর নৌকা ও ট্রলার শ্রমিকের পাশাপাশি মৎস্যজীবীরাও।

আগুনে পুড়ে যেমন খাঁটি সোনা তৈরি হয় তেমনি ট্রলার আগুনে পুড়ে আলকাতরা দেয়া হয়। সবশেষে সুসজ্জিত করে প্রস্তুত করা হয় জেলেদের মাছ শিকার করার যানবাহন। উত্তপ্ত গরমে আলকাতরা যেমন গলে যায়, তেমনই ট্রলার কারিগরের শরীরজুড়ে ঘাম বের হয়। এত উত্তপ্ত গরমের মধ্যেও চলে জীবনসংগ্রাম। জীবনযুদ্ধে হার না মেনে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয় জেলে ও নির্মাণ শ্রমিকদের।

ডক ইয়ার্ড মিস্ত্রি রিপন বলেন, ‘আমার জীবনের ৩০ বছর পার করে দিয়েছি ভাঙাগড়ার খেলায়। যখন পুরানো ট্রলারে কাজ করি মনে হয় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে আছি। সেই ধ্বংসস্তূপকে নতুন রূপ দেয়া আমাদের কাজ। প্রচণ্ড গরমে যখন আলকাতরার কাজ করি তখন মনে হয় মরুর দেশে আছি। গরমে কলিজা সিদ্ধ হয়ে যায়, এভাবেই আমাদের জীবন চলছে।’

কলাপাড়া উপজেলার মৎস্যবন্দর আলীপুর-মহিপুর-আশাখালী ডক ইয়ার্ডে চলছে ফিশিং বোট তৈরি ও মেরামতের কাজ। ট্রলার-নৌকার আকার ও প্রকারে ভেদে মজুরি দেয়া হয় শ্রমিকদের। একটি ট্রলার তৈরি করতে কমপক্ষে দুই লাখ টাকারও বেশি মজুরি আসে। ট্রলার মালিকদের কাছ থেকে কাঠমিস্ত্রির বেতন দৈনিক জন প্রতি এক হাজার ৩০০ টাকা ও সহকারীদের এক হাজার টাকা মজুরি নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। আবার অনেক মিস্ত্রিরা চুক্তি হিসেবেও টাকা নেয়।

২৫ বছরের অভিজ্ঞ কাঠমিস্ত্রি রিপন বালা বলেন, জীবনের অর্ধেক সময় এই ডকে পার করছি, শরীর পাথর হয়ে গেছে। গরম শরীরে লাগে না, বাড়িতে বসে থাকলে তখন গরম বেশি লাগে। তিন মাস কাজ বেশি থাকে, বাকি মাসগুলোতে কাজ কম থাকে। প্রতিদিন ১২ থেকে ১৩ শ’ টাকা করে হাজিরা পাই। জীবন কোনোরকম চলে যায়।

বড় নতুন ট্রলার ৩৪ ফুট লম্বা, ১৫ ফুট চওড়া। ট্রলার তৈরি করতে প্রয়োজন প্রায় ৫০০ সেফটি মেহগনি ও রেইন্ট্রি কাঠ। প্রায় ১৫০ কেজি আলকাতরা। ট্রলারে ৪০ গড়া একটি চায়না ইঞ্জিন ও একটি ২৬ গিয়ার সংযুক্ত করতে হয়। ছোট আকৃতির একটি ট্রলার তৈরিতে প্রায় ১২ লাখ ও বড় আকৃতির সমুদ্রগামী একটি ট্রলার তৈরিতে ২৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা খরচ হয়। গত বছরে ইলিশ না থাকায় এ বছর তুলনামূলক নতুন ট্রলার তৈরি কম হচ্ছে। কিন্তু চলতি মৌসুমে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মিস্ত্রি ও হেলপার এনে ট্রলার তৈরি করেছেন ট্রলার মালিকরা।

শামিম মাঝির নতুন একটি ট্রলার তৈরির কাজে নিয়োজিত কাঠ মিস্ত্রি বলেন, প্রায় এক শতাধিক ট্রলার নির্মাণের কাঠমিস্ত্রি রয়েছেন। পাশাপাশি তাদের সাথে রয়েছে প্রায় দুই শতাধিক সহকারী। ট্রলার ও নৌকার প্রকারভেদে তার অনেক মেরামতের কাজ বা নতুন নির্মাণ করা বেশিরভাগই মালিক পক্ষের সাথে দৈনিক মজুরিতে কাজ করেন তারা।

সামনের মৌসুমে গভীর সমুদ্রে মৎস্য আহরণের জন্য এখানকার মৎস্যজীবীরা সাগর যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মৎস্য আড়ত মালিকদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে কেউ নতুন ট্রলার বানাচ্ছেন কেউ বা পুরোনো ট্রলার মেরামত করছেন। জেলেদের আশা, সাগরে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহের পাশাপাশি আড়তদারের দাদন পরিশোধ করতে পারবেন।

তিন থেকে পাঁচ ইঞ্চি প্রস্থের লম্বা লম্বা কাঠের জোড়ায় জোড়ায় সুতার সলতে ঢোকানোর কাজকে বলা হয় গাইনি। এক ধরনের চিকন লোহা আর হাতুড়ি দিয়ে এ কাজ করা হয় অতি সূক্ষ্মভাবে। গাইনির কাজ শেষে চলে পুটিংয়ের কাজ। কেরোসিন, ধূপ আর পানির সংমিশ্রণে আঠালো এক ধরনের তরল পদার্থ ওইসব সলতের ওপর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। যাকে বলা হয় পুটিং। এ কাজটিও চলে বেশ কয়েকদিন ধরে। এরপর চলে মারামত (মেরামত নয়)। পুরো ট্রলারটির নিচের অংশে আলকাতরা লাগানো হয়। জেলেরা ট্রলারে চড়ে সাগরে মাছ ধরতে যায়। বৈরী আবহাওয়ায় ঝড়-তুফানের মধ্যেও দিনের পর দিন টিকে থাকে ডক ইয়ার্ডের মিস্ত্রি আর শ্রমিকের শ্রমের প্রতীক সেই ট্রলার।

ডক ইয়ার্ডের কারিগর-শ্রমিকরা বলেন, সাগরে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা থাকায় ডক ইয়ার্ডে মাছ ধরার ট্রলারের মেরামতের জন্য অনেক ভিড়, এ কারণে কাজ অনেক বেড়েছে।

তারা আরো বলেন, নিষেধাজ্ঞাকালীন ট্রলারগুলো ঘাটে আসে। তাই এই সুযোগে মালিকপক্ষ ট্রলার মেরামত করে নেয়। মালামালের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌযান মেরামতের খরচও বেড়েছে। প্রতিটি নৌযান মেরামত করতে আকারভেদে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে।

ট্রলার মালিক ইলিয়াস আলী বলেন, প্রতি বছর কমপক্ষে দু’বার ট্রলার মেরামত করাতে হয়। এতে খরচ হয় দুই থেকে তিন লাখ টাকা। মূলত, লবণ পানিতে ট্রলারের কাঠ বেশি নষ্ট হয়, তাই মেরামত করা হয়। মেরামত না করালে লোনায় সব নষ্ট হয়ে যায়।

উপজেলার ১২টি ইউনিয়ন ও দু’টি পৌরসভার নিবন্ধন করা জেলের সংখ্যা ১৮হাজার ৩০৫ জন। এদের মধ্যে চলমান (ভিজিএফ) সুবিধাভোগী জেলেদের সংখ্যা রয়েছে ১০ হাজার ৫৯৩ জন। মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় ৩৭ শতাংশ জেলে। শুধু জীবিকার তাগিদেই নয় প্রতি মুহূর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করে অর্থনীতির চাকা সচল করছেন পেশাদার জেলেরা।

দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের সুষ্ঠু প্রজনন, জলসীমায় মাছের বংশবিস্তার বাড়াতে মাছ ধরার ওপর ৫৮ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। ১৫ এপ্রিল থেকে ১১ জুন পর্যন্ত ৫৮ দিন সাগরে মাছ ধরার উপর সরকার নিষেধাজ্ঞার আরোপ করেছে।

কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘এখন সাগর যাত্রার প্রস্তুতি চলছে। এতে কেউ নতুন এবং কেউ পুরাতন ট্রলার মেরামত করছেন। এসব কাজে নিয়োজিত রয়েছেন কাঠমিস্ত্রিরা। ট্রলারগুলো সুন্দরভাবে মেরামত হলে জেলেরা নিরাপদভাবে বঙ্গোপসাগরে মাছ শিকার করবে।’