দ্বীপ জেলা ভোলার লালমোহনের নিম্মবিত্ত পরিবারের হতদরিদ্র মহিলা ও শিশু-কিশোররা কর্মসংস্থান বা আয়ের উৎস হিসেবে বেঁচে নিয়েছেন ভাঙ্গারি ব্যবসা। এ ব্যবসায় যেন জঞ্জাল থেকে কোটিপতি বনে গিয়েছেন উপজেলার একাধিক ব্যক্তি। নিন্মবিত্ত বা দরিদ্র পরিবারের শিশু-কিশোররা এক সময় বিভিন্ন অপকর্মে বা অপরাধের সাথে জড়িয়ে থাকত। কিন্তু এখন কাজের মধ্যে থেকে অনেকাংশে কমে আসছে তাদের দ্বারা গঠিত বিভিন্ন অপরাধ।
সরেজমিনে দেখা যায়, পলিথিন ও পুরাতন কাগজ আমাদের চারপাশের পরিবেশে যত্রতত্র ছুঁড়ে ফেলা হত যেগুলো পরিবেশ দূষিত করত। কিন্তু ভাঙ্গারি ব্যবসার ক্রমবিকাশের সাথে সাথে পুরাতন প্লাস্টিক জাতীয় সামগ্রী ও প্লাস্টিক বোতলের প্রায় শতভাগই এখন পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা সম্ভব হচ্ছে। এমন অনেক পেপারমিল গড়ে উঠেছে যেগুলো ভাঙ্গারির দোকানেপ্রাপ্ত পুরাতন কাগজ ব্যবহার করে উন্নতমানের কাগজ তৈরি করছে। অর্থাৎ এ ব্যবসার মাধ্যমে একই সাথে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিলাভ ও পরিবেশ সংরক্ষণ করা সম্ভব।
পথশিশু ও হতদরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান ও উপার্জনের নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে এ ব্যবসায়। গরীব ও দরিদ্র কর্মসংস্থানহীন কর্মচারীরা প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরাতন প্লাস্টিকের বোতল, টিন, ফেলে দেয়া কাগজ, ওষুধের কাটুন, পুরাতন ও বাতিল লোহা এবং লোহার যন্ত্রাংশ, অকেজো, নষ্ট ও পুরাতন ইঞ্জিন চালিত অটো, বোরাক ইত্যাদি ভাঙ্গারি হিসেবে ক্রয় করে মহাজনের ভাঙ্গারির আড়তে বিক্রি করে সাবলম্বী ও আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন শত শত দরিদ্র পরিবার।
অনুসন্ধানে জানা যায়, লালমোহন উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার ও যাতায়াত সড়কের মোড় এবং চৌমাথাগুলোতে শতাধিক ভাঙ্গারির দোকান বা আড়ৎ গড়ে উঠেছে। এ সকল আড়ৎদাররা গাওয়াল বা গ্রাম গঞ্জের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিভিন্ন ধরনের ভাঙ্গারি টাকার মাধ্যমে কুড়িয়ে এনে বা সংগ্রহ করে স্ব স্ব আড়তে বিক্রি করে থাকেন।
স্থানীয় সচেতন মহল বলেন, ভাঙ্গারি দোকান দিয়ে একাধিক ব্যক্তি আজ কোটিপতি-স্বাবলম্বী। যদিও এ ব্যবসার মাধ্যমে পথশিশুদের আর্থিক দিক হতে কিছুটা উপকার হচ্ছে, কিন্তু লভ্যাংশ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী ও দোকান মালিকদের তুলনায় তারা খুব কম লাভবান হচ্ছে অর্থাৎ তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। অথচ পথশিশু ও পুরোনো দ্রব্যাদি সংগ্রহকারীরাই এ ব্যবসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করে থাকে যার ফলে তারা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে। ভাঙ্গারি ব্যবসার সাথে জড়িত বেশিরভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেরই ট্রেড লাইসেন্স রয়েছে। যার ফলে কোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কোনোরূপ প্রতারণার আশ্রয় নিলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়াও সহজ হচ্ছে।
সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ এ সম্ভাবনাময় ব্যবসাটির সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। উপজেলার রমাগঞ্জ, ধলীগৌরনগরের একাধিক ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীর সাথে আলাপকালে তারা বলেন, প্রতিদিন সকালে গাওয়ালে বা গ্রামে ফেরি করতে যাওয়া কর্মসংস্থানকারী শিশু-কিশোর ও যুবকদেরকে আমরা অগ্রিম টাকা দিয়ে থাকি।
রমাগঞ্জ ইউনিয়নের আজাহার উদ্দিন রোডের পূর্ব মাথার ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী মো: আলমগীর মিয়া বলেন, ‘আমার দোকানে প্রায় ২৫ থেকে ৩০ জন লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা রয়েছে, আমি ভাঙ্গারি ব্যাবসার পাশাপাশি আরেকটি কারখানা চালু করেছি, সেখানে পুরাতন বোতলও প্লাস্টিক সামগ্রী মেশিনের মাধ্যমে প্রক্রিয়াজাত করে ঢাকায় চালান দিচ্ছি। ওইখানে প্রতিদিন ২০ থেকে ২৫ জন পুরুষ ও মহিলা শ্রমিক কাজ করছেন।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার দোকানের পাইকারদের জন প্রতি ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত দাদন দিয়েছি। তারা প্রতিদিন সকালে গাওয়ালে গিয়ে কিনে বা কুড়িয়ে আনা বিভিন্ন প্রকার ভাঙ্গারি মালাল আমার দোকানে এনে বিক্রি করেন। আমি বাজার দর হিসেবে ক্রয় করে থাকি।’
একই কথা বলেছেন চতলা বাজারের ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী রিপন ও মো: বিল্লাল হোসেন।
চতলার ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী আব্দুস সহিদ বলেন, ‘আমরা প্রতি মাসে দুই থেকে তিনটি করে ভাঙ্গারির ট্রাক ঢাকায় মোকামে বা আড়তে চালান করি। ঢাকার মিডফোড ও নারায়ণগঞ্জের ভাঙ্গারির মিলগুলোতে এ সকল মালামাল আমরা পাঠিয়ে থাকি। এক ট্রাক ভাঙ্গারি ক্রয় করতে ও পাঠাতে ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকা চালান লাগে।’
পূর্ব চর উমেদ গ্রামের ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী মো: মফিজ বলেন, ‘ভাঙ্গারি ব্যবসার পাশাপাশি আমার আরেকটি কারখানা আছে সেখানে পুরাতন ও পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের সামগ্রী মেশিনের মাধ্যমে প্রক্রিয়া বা গুড়া করে ঢাকায় চালান করি। আমার কারখানায় প্রতদিন গড়ে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করছেন। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের দাবি কম লাভে যেন আমাদের ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের জন্য লোনের ব্যবস্থা করেন।’
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেখানে চাকরির অভাব এবং ব্যবসায় ক্রমহ্রাসমান মুনাফা দৃশ্যমান সেখানে ভাঙ্গারি নিঃসন্দেহে একটি লাভজনক ও পরিবেশবান্ধব ব্যবসা। তাই সরকার ও বিভিন্ন দেশ-বিদেশি সহযোগী সংস্থাকে এ ব্যবসার সমৃদ্ধির জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানান সচেতন মহল। যেহেতু এ ব্যবসার পরিবেশগত সুবিধা রয়েছে তাই সরকার এ ব্যবসার প্রতি জনগণকে উৎসাহিত করার জন্য বিশেষ প্রণোদনার বা ভর্তুকির ব্যবস্থা করতে পারে।
সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন ঋণদানকারী সংস্থাগুলো ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের সহজ শর্তে ঋণদান করে এ ব্যবসার উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে পারে। পাশাপাশি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের এমন উপায় এবং পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে যাতে সঠিকপন্থায় এ ব্যবসার তদারকি ও নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তবেই নিকট ভবিষ্যতে ভাঙ্গারি ব্যবসা এদেশের অর্থনীতির জন্য অধিক লাভজনক হতে পারবে।
এ বিষয়ে লালমোহন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: শাহ আজিজকে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনে কল করলে রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।



