ভারতে পালিয়েও শেষ রক্ষা হলো না রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো: আরিফুরজ্জামান আরিফের। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ তাকে আটক করে থানায় সোপর্দ করেছে। তবে কিভাবে তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনা হবে সে বিষয়টি এখনো নিশ্চিত করতে পারেনি পুলিশ।
বাংলাদেশের সাতক্ষীরার কাকডাঙ্গা বিজিবি ক্যাম্পের সুবেদার কামরুজ্জামান গণমাধ্যমকে জানান, শনিবার (২৩ আগস্ট) সন্ধ্যায় বাংলাদেশের সাতক্ষিরার কাকডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে পালিয়ে ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহাকুমার হাকিমপুর চেকপোস্ট পার হচ্ছিলেন তিনি। সেখান থেকে তাকে আটক করে বিএসএফ। তার পরিচয়পত্র দেখে তাকে শনাক্ত করা হয় তিনি বাংলাদেশ পুলিশের কর্মকর্তা আরিফুজ্জামান। বিএসএফ’র হাতে আটকের পর তাকে এখন ভারতের স্বরুপ নগর থানায় রাখা হয়েছে।
সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল মুকিত খান গণমাধ্যমকে জানান, ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক পুলিশ কর্মকর্তা আরিফুজ্জামানকে আটকের পর তাকে বসিরহাট মহাকুমার স্বরূপনগর থানা পুলিশের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। পুলিশ কর্মকর্তার নিকট থেকে একটি পরিচয়পত্র উদ্ধার করেছে ভারতীয় পুলিশ। তবে কোন সীমান্ত দিয়ে ভারতে গিয়েছেন তিনি সে বিষয়ে আমরা এখনো কিছু জানতে পারিনি। তবে বাংলাদেশী ওই পুলিশ কর্মকর্তার পরিচয় আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তার বিরুদ্ধে রংপুর মহানগরীর তাজহাট, কোতয়ালী থানায় হত্যা, হত্যাচেস্টার পাঁচটি মামলা রয়েছে।
রংপুর মহানগর পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (হেড কোয়ার্টার্স) হাবিবুর রহমান জানান, আরিফুজ্জামানের বাড়ি নীলফামারীতে। গত বছর ৫ আগস্টের পর তাকে রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ থেকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা এপিবিএনে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে বদলি করা হয়। এরপর থেকে পলাতক হন তিনি। গত বছর ১৪ আগস্ট বিনা অনুমতিতে কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকার অভিযোগে মো: আরিফুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গনির সই করা এক প্রজ্ঞাপনে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
পুলিশের এই কর্মকর্তা আরো জানান, মো: আরিফুজ্জামান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি। ওই মামলায় ৩০ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জ গঠনের পর সাক্ষ্য গ্রহণ চলছে। এর মধ্যে ছয়জন গ্রেফতার আছেন। এছাড়াও আরিফুজ্জামান রংপুর মহানগর তাজহাট থানায় শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলার (নম্বর-০৩, তারিখ-১৯-০৮-২৪)) ৪ নম্বর, কোতয়ালী থানায় কলা ব্যবসায়ী শহীদ মেরাজুল ইসলাম হত্যা মামলার (নম্বর-১২-তারিখ-১৯-০৮-২৪) ২১ নম্বর, একই থানায় সবজি ব্যবসায়ী শহীদ সাজ্জাদ হোসেন হত্যা মামলার (নম্বর-১৪ তারিখ-২১-০৮-২৪), ১৬ নম্বর আসামি। এছাড়াও কোতয়ালী থানায় কলেজ শিক্ষার্থী জিম হত্যা চেষ্টা মামলার (নম্বর-২৯, তারিখ-৩১-০৮-২৪) ৫ নম্বর ও পল্লী চিকিৎসক জাহাঙ্গীর আলম সিদ্দিকি হত্যা চেষ্টা মামলার (২৪ নম্বর, তারিখ-২০-১১-২৪) ২ নম্বর আসামি তিনি।
রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো: মজিদ আলী জানান, ২৪ এর জুলাই বিপ্লবের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে সব থেকে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেন এই পুলিশ কর্মকর্তা। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই জিলা স্কুল মোড় থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার সময় ক্যাপ্টেন ব্যাকোলোজি মোড়ে শিক্ষার্থীদের মিছিল আটকে দিয়ে বেধড়ক লাঠিচার্জে নেতৃত্ব দেন তখনকার এসি আরিফুজ্জামান। এছাড়াও শহীদ আবু সাঈদকে গুলি করার আগে এবং পরে খুব কাছে থেকে নির্দেশ দেন আরিফ এবং নিজেও গুলি করেন।
দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, যেহেতু ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন অনুপ্রবেশের দায়ে। সেখানে কি মামলা হয় সেটা আগে দেখতে হবে। এরপর এটা দুই দেশের মন্ত্রণালয়ের ব্যাপার। মন্ত্রণালয় টু মন্ত্রণালয় যোগাযোগ করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসবে। আমরা তার বিষয়ে মামলা এবং অন্য নথিপত্রগুলো যথাযথভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোতে প্রেরণ করেছি।
পুলিশসূত্র জানায়, গত বছর ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় সিটি বাজার সামনে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গুলিতে নিহত কলা ব্যবসায়ী সাজ্জাদ হোসেন হত্যা মামলায় বাদির কাছ থেকে কৌশলে হলফনামা করে নাম কর্তন করে নেন পুলিশের এই কর্মকর্তা।
২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলার সময় ক্যাপ্টেন ব্যাকোলোজি মোড়ে পুলিশের হামলায় আহত ক্যান্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী মাহদি হাসান অনিক জানান, ‘আমরা সেদিন ক্যাফে ৬৬ এলাকায় ক্যান্টের শতাধিক শিক্ষার্থী একত্রিত হই। এরপর মিছিল নিয়ে জিলা স্কুল মোড়ে আসি। সেখানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছিলেন। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেই। পথে বেশ কয়েকবার এসি আরিফের নেতৃত্বে আমাদের মিছিল আটকিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে পুলিশ। ক্যাপ্টেন ব্যাকোলোজি মোড়ে এসি আরিফুজ্জামান পুলিশকে দিয়ে কৌশলে কিছু শিক্ষার্থীদের এগিয়ে দিয়ে পেছনের শিক্ষার্থীদের বাঁধা দেয়। পুলিশের দুইজন আমাকে ধরে ফেলে। আমার ঘাড়ে হাত পেঁচিয়ে দেয়। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা। তবুও আমি ছোট মানুষ হওয়ায় কায়দা করে পুলিশের হাত থেকে বের হয়। পুলিশ আবারো আমাকে ধরার চেষ্টা করে। আমি তখন দৌড়ে মিছিলের সামনে যাই। এসময় তারা রুশানসহ আরো একজনকেও এভাবে ঘাড় মটকায়। শুরু থেকেই এসি আরিফ আমাদের ওপর মারমুখি ছিল। তিনি খুব আগ্রাসী ভূমিকায় ছিলেন।’