রাঙ্গাবালীতে সালিশের নামে শিক্ষার্থীসহ ৫ জনকে ন্যাড়া করার অভিযোগ

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে জমি বিরোধের ঘটনায় সালিশের নামে দুই শিক্ষার্থীসহ পাঁচ তরুণের মাথা ন্যাড়া করে অপমানের অভিযোগ উঠেছে; ইউএনও তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন।

রবিন আহম্মেদ, পায়রা বন্দর (পটুয়াখালী)

Location :

Patuakhali
অভিযুক্ত ইউপি সদস্য রেশাদ খলিফা, ডানে- শিক্ষার্থীসহ ৫ জনকে ন্যাড়া করা হচ্ছে
অভিযুক্ত ইউপি সদস্য রেশাদ খলিফা, ডানে- শিক্ষার্থীসহ ৫ জনকে ন্যাড়া করা হচ্ছে |নয়া দিগন্ত

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালীতে জমি-জমা নিয়ে বিরোধের জেরে মারামারির ঘটনায় সালিশের নামে দুই শিক্ষার্থীসহ পাঁচ তরুণকে বখাটে আখ্যা দিয়ে মাথা ন্যাড়া করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে।

সোমবার দুপুরে রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিব দাশ পুরকায়স্থ ঘটনার তদন্তে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো: আসাদুজ্জামানকে কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

এর আগে, গত রোববার (২৬ অক্টোবর) সকালে উপজেলার মধ্য চতলাখালীর খুতির বাজার এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

ভুক্তভোগীরা হলেন ১৮ বছর বয়সী রাব্বি (কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র), ২১ বছরের রিয়ান (গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত), ১৭ বছরের রাতুল (মাদরাসার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী), ১৯ বছরের শাকিল (গৃহস্থালি শ্রমিক) ও ১৮ বছরের নয়ন সরদার (রাজমিস্ত্রির সহকারী)।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, মধ্য চতলাখালী গ্রামের মনির গোলদার ও মোজাম্মেল মৃধার মধ্যে জমি-জমা নিয়ে বিরোধ চলছিল। এ নিয়ে শুক্রবার দু’জনের মধ্যে কথা কাটাকাটি ও হাতাহাতি হয়। এ সময় বাবার সাথে মিলে মনিরকে লাঞ্ছিত করেন মোজাম্মেলের ছেলে রিয়ান। এ জেরে শনিবার রাতে মনির গোলদারের ছেলে রাব্বি ও মোজাম্মেলের ছেলে রিয়ান তর্কে জড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে রাব্বি রিয়ানকে মারধর করেন। পরে রিয়ানকে মারধরের ঘটনাটি তার বাবা মোজাম্মেল স্থানীয় ইউপি সদস্য রেশাদ খলিফাকে জানান। রোববার সকালে ইউপি সদস্য রেশাদ খলিফার উপস্থিতিতে মধ্য চতলাখালীর খুতির বাজার এলাকায় সালিশ বসে। সেখানে দু’পক্ষসহ স্থানীয় লোকজনকে ডেকে এনে তিনি পাঁচ তরুণকে বখাটে আখ্যা দিয়ে মাথা ন্যাড়া করার নির্দেশ দেন। একপর্যায়ে নিজেই নাপিত ডেকে এনে মাথা ন্যাড়া করে দেন।

মাথ্যা ন্যাড়া হওয়া ভুক্তভোগী নয়ন সরদার বলেন, ‘আমাদের অপরাধ আমরা রাব্বি ও রিয়ানের মারামারি থামিয়েছি। এ কারণে সকালে মেম্বার আমাকে ফোন দিয়ে ডেকে নিয়েছেন। গিয়ে দেখি বাজার থেকে ডেকে নাপিত নিয়েছেন। ওই নাপিত দেখি দু’জনের মাথা ন্যাড়া করে দিছে। পরে আমাকেও মাথা ন্যাড়া করে দেন। আমি অনুরোধ করেছি, মেম্বার আমার কথা শোনেনি। খবর পেয়ে আমার আম্মু গেছেন। গিয়ে জিজ্ঞেস করেছেন, আমার ছেলের চুল কে কাটছে? মেম্বার বলছেন আমি কাটছি।’

ছেলের অপমানের ঘটনার বর্ণণা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে নয়ন সরদারের মা ঝর্ণা বেগম বলেন, ‘আমি মানুষের কাছে এ সমস্ত ঘটনা শুনে গেছি। আমি অভিভাবক, আমি তো আছি। আমার ছেলে কোনো অপরাধ করলে আমাকে ডাকতো। সে তো কোনো অপরাধ করেনি। মারামারি দেখে থামিয়েছে। মেম্বারকে বলছি বিনা অপরাধে আমার ছেলের মাথা কে কামিয়েছেন? বলছে আমি পারছি, কামাইছি। পাঁচজনের কামাইছি।’

মাথা ন্যাড়া করে অপমানের শিকার রাব্বি বলেন, ‘রিয়ান ভাইর সাথে আমার মারামারি হয়েছে। স্থানীয় রেশাদ মেম্বার (ইউপি সদস্য) এসে চৌরাস্তায় (খুতির বাজার) সালিশ করে দিছেন। রিয়ান ও আমারসহ পাঁচজনের চুল কেটে দিছেন। ওই তিনজন মারেনি, ওদেরও চুল কেটে দিছেন।’

রাব্বির মা মাহফুজা বলেন, ‘জমি-জমা ঝামেলা নিয়ে রাব্বির বাবাকে মারধর করেছে রিয়ান ও তার বাবা। এটা কোনো ছেলে মেনে নিতে পারে? তাই রিয়ানকে এ কথা জিজ্ঞস করতে গিয়ে মারামারি হয়েছে। সেটা নিয়ে রেশাদ মেম্বার সবার চুল কেটে দিছেন।’

এ বিষয়ে রিয়ানের বাবা মোজাম্মেল মৃধা বলেন, ‘রাব্বির বাবা মনিরের সাথে আমার যে সমস্যা হয়েছিল, তা মিটমাট হয়ে গেছে। তারপর মনিরের ছেলে এসে আমার ছেলেকে মারধর করেছে। আমার ছেলেকে চার-পাঁচজন মিলে মেরেছে। আমি মেম্বারের কাছে বিচার চাইছি। মেম্বার এসে বিচার করে দিছেন। মাফ চাওয়াইছেন। আর আমার ছেলেসহ সবার চুল কেটে দিছেন।’

এ ঘটনায় এলাকায় ক্ষোভ ও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। ভুক্তভোগী কয়েকটি পরিবার অপমানে মুখ লুকাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একাধিক ব্যক্তি বলেন, ‘রাব্বি ও রিয়ানের মারামারি থামাতে গিয়েছিলেন অন্য তিনজন। কিন্তু সালিশিতে তাদের কথা শোনা হয়নি।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইউপি সদস্য রেশাদ খলিফা। তিনি বলেন, ‘যা হয়েছে দুই পরিবারের লোকজন করেছেন। তারা বিষয়টি নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে গিয়েছেন। আমি এর সাথে জড়িত নই।’

গ্রাম আদালতের রাঙ্গাবালী উপজেলা কো-অর্ডিনেটর মো: ইমাম হোসেন সায়েম বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদের বাইরে সালিশ করার সুযোগ নেই। আর সালিশের নামে যা হয়েছে তা সম্পূর্ণ আইনবহির্ভূত। জনপ্রতিনিধির এমন ক্ষমতা নেই।’

ইউএনও রাজিব দাশ পুরকায়স্থ বলেন, ‘তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রতিবেদন পাওয়ার পর এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

রাঙ্গাবালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শামীম হাওলাদার জানান, ‘বিষয়টি শুনেছি। কোনো পক্ষ থেকে অভিযোগ আসেনি। তবে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে।’