আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর

দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছে না দক্ষিণ জনপদের মানুষ

১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় গোর্কির আঘাতে দক্ষিণাঞ্চলের চার লাখেরও বেশি ঘর-বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৬ লাখ মানুষ। শুধু ভোলাতেই মৃত্যু হয় অন্তত পাঁচ লাখ মানুষের।

শাহাদাত হোসেন শাহীন, ভোলা

Location :

Bhola
১৯৭০ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড দক্ষিণাঞ্চল।
১৯৭০ সালের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ে লণ্ডভণ্ড দক্ষিণাঞ্চল। |নয়া দিগন্ত

আজ ভয়াল ১২ নভেম্বর। ১৯৭০ সালের এদিনে প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় গোর্কির আঘাতে দক্ষিণাঞ্চলের চার লাখেরও বেশি ঘর-বাড়ি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩৬ লাখ মানুষ। শুধু ভোলাতেই মারা যায় অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ। ঘটনার ৫৫ বছর পরও সে দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারছে না দক্ষিণ জনপদের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষরা।

ওই দিন রাতে ভয়াল ঘূর্ণিঝড়ের ছোবলে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল ভোলার বিস্তীর্ণ জনপদ। জেলার মনপুরা, চর নিজাম, ঢালচর, কুকরি-মুকরিসহ গোটা এলাকা মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছিল।

স্থানীয়দের মতে অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ মারা গিয়েছিল ভোলায়। সেদিন ভোলার এমন কোনো গ্রাম ছিল না, যে গ্রামের কেউ না কেউ মারা যায়নি। আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় গাছে উঠে প্রাণ বাঁচায় অনেকে। ঘর-বাড়ি ফসল আর প্রিয়জন হারিয়ে শোকে কাতর হয়ে পড়েন মানুষ। গোর্কির আঘাত ও জলোচ্ছ্বাসের ভয়াবহতা এতই নির্মম ছিল যে, সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও আতঙ্ক আর ভয়ে শিহরে ওঠে ভোলাবাসির প্রাণ।

সে দিনের সে বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে মো: আনোয়ার মিয়া বলেন, ‘১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ভোলাসহ উপকূলীয় এলাকা দিয়ে বয়ে যায়। ১০ তারিখ থেকেই গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ছিল, ১১ তারিখ সারাদিনই বৃষ্টি ছিল— সাথে হালকা বাতাস। ১২ তারিখে রাতে প্রচণ্ডভাবে আঘাত হানে। তখন কোনো ধরনের সিগন্যাল বা আবহাওয়ার কোনো খবর, কোনো কিছুই ছিল না। সকালে দেখলাম সদর রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় এক মাজা পরিমাণ পানি, সবকিছু ডুবে গেছে। সবদিকে ঘুরে দেখলাম, সকল বাড়ি-ঘর, গাছপালা একদম ভেঙে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। সব জায়গায় লাশ আর লাশ। মানুষের গবাদিপশুসহ সকল কিছু নষ্ট হয়ে গেছে। যারা বেঁচে ছিল তাদেরও ছিল না বেঁচে থাকার মতো কোনো সম্বল। ছিল না কোনো খাবার বা পরনে কোনো পোশাক। সে দিনের সে ভয়াবহ স্মৃতির কথা মনে পড়লে এখনও প্রাণ আঁতকে ওঠে।’

মো: আলমগীর গোলদার বলেন, ‘ঝড়ের পরের দিন দেখলাম নৌকাগুলো সব গাছের মাথায় আটকে আছে। গাছে গাছে মানুষের লাশ এবং সাপ একত্রে পেচিয়ে আছে। কত মানুষ যে মারা গেছে সে হিসেব করার মতো কোনো অবস্থা ছিল না। নদীতে কচুরিপানার মতো মানুষের লাশ ভাসছিল। মানুষকে গণকবর দেয়া হয়েছে। এক কবরে কতজন করে দেয়া হয়েছে। সে হিসাব করা সম্ভব হয়নি। সে কথা মনে উঠলে এখনো গা শিউরে ওঠে। এখনো বাতাস-বৃষ্টি দেখলে বা কোনো সিগন্যালের কথা শুনলে ভয়ে ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে বসে থাকি।’

মো: আবু তাহের বলেন, ‘ঝড়ের কয়েকদিন পরে ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষদের সহায়তার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে আসেন। এরপর আসেন মাওলানা হামিদ খান ভাসানী।’

তিনি আরো বলেন, ‘সে সময় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং কোনো সাইক্লোন শেল্টার না থাকায় ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে। এখনো ভোলায় পর্যাপ্ত আশ্রয় কেন্দ্র বা সাইক্লোন শেল্টার নেই। তাই আরো বেশি পরিমাণে সাইক্লোন শেল্টার বা আশ্রয় কেন্দ্র, কিল্লাসহ বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ সংস্কার দরকার। শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের দুর্দশা দেখার জন্য ভোলা সদর, মনপুরা ও কুকরি-মুকরিসহ বিভিন্ন এলাকায় আসেন। তার নির্দেশেই ভোলার মানুষের জান-মাল ও গবাদিপশু রক্ষায় বনায়ন ও কিল্লা নির্মাণের কাজ শুরু হয়। তবে এখনো প্রয়োজন অনুযায়ী আশ্রয় কেন্দ্র নির্মিত না হওয়ায় বিভিন্ন চরাঞ্চল ও দুর্গম এলাকার ছয় লক্ষাধিক মানুষের দিন কাটে চরম নিরাপত্তাহীনতা ও ঝুঁকির মাঝে।’

ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির উপ-পরিচালক জানিয়েছেন, ১৯৭০ সালে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা কম ছিল কিন্তু এখন বন্যা নিয়ন্ত্রণে সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। ভোলা জেলায় বিভিন্ন ঝড় মোকাবেলা করার জন্য সিপিপির ১৩ হাজার স্বেচ্ছাসেবী ও ৭৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে।

এছাড়া ভোলা জেলায় আরো কিছু আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করা হবে বলেও জানান তিনি।