খাদেমুল বাবুল জামালপুর ও মাদারগঞ্জ সংবাদদাতা
গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয় মো: ইমরান(২২)। দীর্ঘদিন হাসপাতালে মৃত্যু শয্যায় থেকে বেঁচে বাড়ি ফিরলেও সম্পূর্ণ স্মৃতি ফিরে পায়নি ইমরান। এখনো শুকায়নি মাথায় লাগা গুলির ক্ষতচিহ্ন।
ছেলের চিকিৎসার খরচ জোগাতে পরিবারের আয়ের একমাত্র সম্বল অটোরিকশাটিও বিক্রি করে দিয়েছেন বাবা বিল্লাল মিয়া ।
ইমরানের বাবার অটোরিকশার চালানোর টাকায় চলত ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ ও সংসারের ব্যয়।
মো: ইমরানের জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার বালিজুড়ী ইউনিয়নের তারতাপাড়া গ্রামের বিল্লাল মিয়া ছেলে। এইচএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন ইমরান। মেধাবী ছাত্র ইমরানের পরিবারের দারিদ্রতার কারণে উচ্চশিক্ষা অর্জন সম্ভব হয়নি। ইমরানদের মা-বাবা, দুই ভাইবোন ও বৃদ্ধা দাদী রয়েছেন।
ভাইবোনদের মধ্যে ইমরান সবার বড়। বাবা বিল্লাল পেশায় একজন রিকশাচালক।
ইমরানদের বসতঘরের জায়গা ছাড়া চাষযোগ্য কোনো জমি নেই। অভাব অনটনের সংসারে বাবাকে সাহায্য করতে ইমরান স্থানীয় একটি কিন্ডার গার্ডেন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। এরপর পরিবারের সচ্ছলতা ফেরাতে পাড়ি জমাতে চেয়েছিলেন ইতালিতে। এজন্য স্থানীয় এক আদমব্যবসায়ীর কাছে টাকা ও পাসপোর্ট জমা দিয়েছিলেন তিনি।
ইতালি যেতে আরো বেশ কয়েকমাস সময় লাগবে জেনে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় একটি কুরিয়ার সার্ভিসে চাকরি নেয় ইমরান। মেধাবী হয়েও উচ্চশিক্ষার সুযোগ না পেয়ে জুলাই ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরুতেই আন্দোলনের অংশ নেন তিনি।
জানা যায়, ৪ আগস্ট বিকেলে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথে ছাত্র-জনতার ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। সেই সময় পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা আন্দোলনকারীদের লক্ষ করে গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়া হয়। এ সময় ইমরান মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আন্দোলনকারীরা ইমরানকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলেও তাকে চিকৎসা দেয়া হয়নি।
পরে ইমরানকে আশুলিয়া মা ও শিশু হাসপাতালে নেয়া হয়। ইমরানের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপালে নেয়া হয়। চিকিৎসকরা সাড়ে ৪ ঘণ্টার চেষ্টায় ইমরানের মাথা থেকে গুলি বের করতে সক্ষম হন।
ইমরানের শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় ২৫দিন পর সিএমএইচ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে তিনমাস চিকিৎসা নেয়ার পর কিছুটা সুস্থ হলে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়।
অটোরিকশা বিক্রির টাকা এবং অন্য সহায়তায় চিকিৎসা শেষে ইমরান বাড়িতে ফিরলেও বাবার আয়ের শেষ সম্বল রিকশাটি বিক্রি করে এখন অসহায় হয়ে পড়েছে পরিবারটি।
সংসারে আয়ের একমাত্র অবলম্বন অটোরিকশাটি বিক্রি করায় সংসারের আয় বন্ধ হয়ে গেছে বিল্লাল মিয়ার। ফলে ধারদেনা ও অন্যের সাহায্য নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন জুলাই যোদ্ধার পরিবারটি।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ইমরানের বাবা বিল্লাল বলেন, ‘পরিবারের আয়ের একমাত্র উৎস ছিল আমার রিকশা আর ছেলের সামান্য আয়। ছেলের চিকিৎসার জন্য রিকশাটি বিক্রি করে দিয়েছি। এখন পরিবার নিয়ে চলতে পারছি না। স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ইমরানের চিকিৎসা করাতে প্রায় ছয় লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এরমধ্যে জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে চার লাখ, ডিজিএফআই অফিসার দিয়েছে ১০ হাজার, জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে ১০ হাজার, জামায়াতের থেকে ১০ হাজার, মাদারগঞ্জ উপজেলা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক মোখলেছুর রহমানের পক্ষ থেকে একমাসের বাজার ও নগদ ৫ হাজার টাকা, স্থানীয় সমাজসেবা অফিস থেকে তিন হাজার টাকাসহ মোট চার লাখ ৩৮ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছি।’
সরকারের নিকট তিনি ছেলের সুচিকিৎসার দাবি জানান। যারা তার ছেলের মাথায় গুলি করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চায় অসহায় এই বাবা।
এ ঘটনায় বিল্লাল আশুলিয়া থানায় একটি মামলা করেছেন।