কুষ্টিয়ায় চিকিৎসকের বাসায় রাতভর প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষার অভিযোগ

কুষ্টিয়ায় সিভিল সার্জন অফিসের নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

আ ফ ম নুরুল কাদের, কুষ্টিয়া

Location :

Kushtia
কুষ্টিয়ায় চিকিৎসকের বাসায় রাতভর প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষার অভিযোগ
কুষ্টিয়ায় চিকিৎসকের বাসায় রাতভর প্রশ্নফাঁস ও পরীক্ষার অভিযোগ |নয়া দিগন্ত

কুষ্টিয়ায় সিভিল সার্জন অফিসের নিয়োগ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। পরীক্ষার আগের রাতে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আর এমও ডা: হোসেন ইমামের বাড়িতে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষার্থীদের ‘প্রশিক্ষণমূলক পরীক্ষা’ নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। শুধুই অভিযোগ নয়- সাংবাদিকরা প্রমাণ পেয়েছে ভিডিও ফুটেজ ও ছবি তুলেছে ওই দুর্নীতির চিত্রের। তবে ওই চিকিৎসক সাংবাদিকদের নিকট এঘটনার মিথ্যা বানোয়াট বলে জানিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার (২৪ অক্টোবর) গভীর রাতে এ ঘটনা ঘটে।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, কুষ্টিয়া ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার (আরএমও) ডা: মোহাম্মদ হোসেন ইমামর বাসায় জেলার বিভিন্ন উপজেলা থেকে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ জন পরীক্ষার্থীকে এনে পরীক্ষার প্রশ্ন দেখানো হয়। সারারাত চলে ওই তথাকথিত প্রস্তুতিমূলক পরীক্ষা।

পরদিন সকালেই ওই একই পরীক্ষার্থীরা অংশ নেন সিভিল সার্জন অফিসের অধীনে সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌছে সাংবাদিকরা এসব কিছুই গিয়ে সত্যতা পান এবং ভিডিওচিত্র ধারণ করেন। ফুটেজে দেখা যায়, বেশ কিছু পরীক্ষার্থী গভীর রাতে ডাক্তারের বাসাতে প্রবেশ করছে এবং সকালে পরীক্ষার ঠিক কিছু সময় আগে বাসা থেকে বেরিয়ে আসছে এবং পরীক্ষা কেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন।

এসময় সাংবাদিকদের দেখে ওই ভবনের গেট থেকে প্লাস্টিকের ফাইল হাতে পরীক্ষার্থীরা বের হচ্ছে। এসময় সাংবাদিকরা ছবি তুলতে গেলে দ্রুত পা হেটে এবং দৌড়ে সেখান থেকে পরীক্ষা কেন্দ্রের দিকে চলে যায়।

এসময় একজন পরীক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম পরীক্ষা সঠিকভাবে হবে, কিন্তু রাতে অনেককে ডেকে নিয়ে গিয়ে প্রশ্ন দেখানো হয়েছে। যারা টাকা দিয়েছে, তারাই আগেই প্রশ্ন পেয়েছে।’

নাম প্রকাশে একজন অভিভাবক বলেন, ‘আমাদের সন্তানরা পরিশ্রম করে প্রস্তুতি নিয়েছে, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যোগ্যতা নয়, টাকা-পয়সাই সবকিছু। এটা ভীষণ হতাশাজনক।’

এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে জেলাজুড়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা। অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে পরীক্ষা স্থগিত ও নতুন করে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন।

জানা গেছে, কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন কার্যালয় সম্প্রতি সাতটি পদে মোট ১১৫ জন নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। অনলাইনে আবেদন গ্রহণ করা হয় ৪ মার্চ থেকে ২৪ মার্চ পর্যন্ত। এতে, স্বাস্থ্য সহকারী ৯৭ জন, পরিসংখ্যানবিদ ৩ জন, কোল্ড চেইন টেকনিশিয়ান ১ জন, স্টোর কিপার ৪ জন, সাঁট-মুদ্রাক্ষরিক কাম কম্পিউটার অপারেটর ১ জন, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক ৫ জন, ড্রাইভার ৪ জন।

নিয়ম মাফিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) সকাল ১০ টার দিকে শহরের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে।

এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন ডা: শেখ মোহাম্মদ কামাল হোসেন ও আরএমও ডা: মোহাম্মদ হোসেন ইমামের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

তবে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন জানান, কুষ্টিয়ার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের আরএমও কোনোভাবেই নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে সম্পৃক্ত নন। যেহেতু তিনি সরকারি কর্মচারী, তাই শিক্ষার্থীরা উনার বাসায় গেছে সেটা সম্পূর্ণ আইনবিরোধী।

এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগের খুলনার পরিচালককে জানানো হয়েছে, তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছে বিষয়টি তদন্ত করার জন্য।

এদিকে সাধারণ পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা দাবি করেছেন ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে যোগ্য প্রার্থীরা এমন অবিচারের শিকার না হন।

সূত্রে জানা গেছে, সিভিল সার্জন অফিসের নিয়োগের বিষয়টি জেলা প্রশাসক নিজেই দেখভাল করছেন। এই নিয়োগ কমিটির সভাপতি খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক। জেলা প্রশাসকের দফতরের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে এই নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে জড়িত থাকার কথা।

জানা যায়- গত কয়েক দিন পুর্বে কুষ্টিয়ার একজন সিনিয়র সাংবাদিক কৌশলে সিভিল সার্জনের নিকট একজন প্রার্থীর সুপারিশ নিয়ে যান। সাংবাদিক যত টাকা লাগুক তিনি একজন প্রার্থীকে চাকরি দেয়ার অনুরোধ জানান।

এসময় সিভিল সার্জন ওই সাংবাদিককে বলেন, ‘আমার নিয়ন্ত্রণে নেই, চাকরির বিষয়টি সম্পূর্ণ দেখভাল করছেন জেলা প্রশাসক নিজেই। আপনি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগাযোগ করুন তাকে ম্যানেজ করতে পারলে আপনার সুপারিশ কার্যকর হবে। আর এরই ধারাবহিকতায় জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ড. হোসেন ইমামের কালিশংকপুর বাড়িতে ওই সংখ্যক প্রার্থীদের রাতে অ্যাম্বুলেন্সে করে এনে রাতেই প্রশ্নপত্র হাতে দিয়ে পরিক্ষায় অংশ গ্রহণের সুযোগ করে দিয়েছেন।

বিষয়টি আরো নিশ্চিত হওয়া গেছে, ভোরে সাংবাদিকরা ওই চিকিৎসকের বাসায় হানা দিয়ে ভিডিও ফুটেজ ও স্থির ছবি ধারণ করার পর ডা: হোসেন ইমামের ভাই ঘটনাস্থলে থাকা একজন সাংবাদিককে পুরো ঘটনা ধামা চাপা দেয়ার জন্য ৫ লাখ টাকার অফার দেন। এসময় ঐ সাংবাদিক তা প্রত্যাখান করে ঘটনাস্থলে ত্যাগ করেন।

এবিষয়ে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক বলেন, আরএমও এই ভর্তি কমিটির কেউ না। তার বাড়িতে এই ধরনের ঘটনা ঘটলে তা তদন্ত করলে বুঝা যাবে। এদিকে জেলা প্রশাসক এই নিয়োগ বাণিজ্যের সাথে জড়িত নন বলে জানান। তিনি অস্বীকার করে বলেন, মেধা আর যোগ্যতার ভিত্তিতে কুষ্টিয়া সিভিল সার্জন অফিসের নিয়োগ দেয়া হবে। কারন একহাজারের বেশি শহীদদের বিনিময়ে মেধাবীদের যোগ্যস্থানে পৌঁছে দেয়ার কাজটি আমদেরই করতে হবে।

তিনি বলেন, ‘নিয়োগের সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এই নিয়োগ কমিটির সভাপতি খুলনা বিভাগীয় স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক আর আমার একজন প্রতিনিধি কমিটিতে আছেন।‘

এদিকে প্রশাসনের বিরুদ্ধে সিভিল সার্জন অফিসের নিয়োগ বানিজ্যের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে রোববার সকালে সচেতন নাগরিকদের উদ্যোগে জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে।