রংপুর মহানগরী ও আশপাশের আট জেলায় প্রায় ৯০ শতাংশ কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন, অংশগ্রহণকারী কমিটি কিংবা সেইফটি কমিটি নেই। ফলে শ্রমিকরা ন্যায্য মজুরি, নিরাপত্তা ও যৌন হয়রানির মতো গুরুতর সমস্যায় পড়ছেন। উৎপাদন কার্যক্রমেও দেখা দিচ্ছে বিঘ্ন।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের রংপুর অফিস সূত্রে জানা গেছে, বিভাগে ২ হাজার ২২২টি উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান রয়েছে- যার মধ্যে মাত্র ২৭টিতে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বমূলক কমিটি রয়েছে। বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ (সংশোধিত) এর ধারা ২০৫-২০৮ এবং শ্রম বিধিমালা, ২০১৫ (সংশোধিত) এর বিধি ১৮৩-২০২ অনুযায়ী, ৫০ জনের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী থাকলে গোপন ব্যালটের মাধ্যমে শ্রমিক ইউনিয়ন বা অংশগ্রহণকারী কমিটি গঠন বাধ্যতামূলক। সেইফটি কমিটিও থাকতে হয়। কিন্তু রংপুর বিভাগে এসব বিধান ভয়াবহভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এসব কমিটি না থাকায় মাসিক বা দ্বিমাসিক বৈঠক হচ্ছে না, শ্রমিকরা মালিকের কাছে তাদের সমস্যা তুলে ধরতে পারছেন না। নারী শ্রমিকদের যৌন হয়রানি, ছুটি সংক্রান্ত জটিলতা, নিরাপত্তা ঘাটতি- সবই থেকে যাচ্ছে অনুচ্চারিত। ফলে শ্রমিকরা বার্গেইনিংয়ের সুযোগ হারাচ্ছেন, উৎপাদন ও শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে।
২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর শ্রম অধিদফতর কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়। ১৭ জুন রংপুর বিভাগীয় বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার মালিক সমিতির সঙ্গে মতবিনিময় সভা করে শ্রম আইন ও বিধিমালা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হয়। তবে মালিকপক্ষের সাড়া ছিল সীমিত। শুধু রংপুরের গুড হেলথ হাসপাতাল অংশগ্রহণকারী কমিটি গঠন করেছে।
রংপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারী ও লালমনিরহাট জেলায় ১০০টিরও বেশি হাসপাতাল ও ক্লিনিক এবং ৩০টিরও বেশি কলকারখানায় কমিটি গঠনের বিষয়ে শ্রম অধিদফতর থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। কিন্তু বেশিভাগই প্রতিষ্ঠানই তা আমলে নেয়নি।
শ্রম অধিদফতরের লেবার ইন্সপেকশন ম্যানেজমেন্ট অ্যাপ্লিকেশন (লিমা) অনুযায়ী, সারাদেশে ১ লাখ ৬৬ হাজার ৩৪৫টি কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৩২০টিতে সেইফটি কমিটি রয়েছে।
এদিকে শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ কোম্পানির বিরুদ্ধে রংপুর বিভাগীয় শ্রম আদালতে মামলা করেছে আঞ্চলিক শ্রম অধিদফতর। মামলাটি গ্রহণ করে আদালত আগামী ২৪ নভেম্বর পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছে।
আদালত সূত্রে জানা যায়, ১৫ অক্টোবর মামলাটি দায়ের করেন আঞ্চলিক শ্রম দফতরের সহকারী পরিচালক মো: আতাউর রহমান মণ্ডল। সিনিয়র জজ একে ফজলুল হক মামলাটি (২৩/২০২৫) গ্রহণ করেন।
মামলার বিবরণে বলা হয়, চলতি বছরের ৩ ফেব্রুয়ারি রংপুর সিও বাজার এলাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকো কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালককে শ্রম আইন অনুযায়ী অংশগ্রহণকারী কমিটি গঠনের জন্য চিঠি দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটি ১২ ফেব্রুয়ারি ১৬ জন স্থায়ী কর্মচারীর তালিকা দিয়ে জবাব দেয়। ১৬ মার্চ সরেজমিন পরিদর্শনের নোটিশ দেয়া হয় এবং ১৯ মার্চ তদন্তে দেখা গেছে, সেখানে ৫০ জনের বেশি কর্মচারী রয়েছেন। লিমা ওয়েবসাইটে প্রতিষ্ঠানটির রংপুর সদর ক্যাম্পাসে ৫০৮ জন শ্রমিকের তথ্য রয়েছে।
সহকারী পরিচালক আতাউর রহমান মণ্ডল জানান, প্রতিষ্ঠানটি শ্রম আইন ২০০৬ এর ধারা ২০৫-২০৮ এবং শ্রম বিধিমালার বিধি ১৮৩-২০২ লঙ্ঘন করেছে। মামলায় শ্রম আইনের ধারা ২৯২, ২৯৩, ৩০৩ (ঙ), ৩০৬ (২), ৩০৭ ও ৩০৯ উল্লেখ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য শুধু জরিমানা নয়, প্রতিষ্ঠানগুলো যেন আইন মেনে চলে, সেটাই নিশ্চিত করতে চাই।’



