‘রাষ্ট্র কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য সেবা করার সুযোগ’ উল্লেখ করে মেক্সিকোতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারী বলেছেন, ‘কর্তৃত্ব নয় ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমে সেবা করার জন্য দেশের জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে, নিতে হবে আপন করে।’
তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটে যাওয়ার পর যতই আপনি উন্নয়নের কথা বলেন, যদি মানসিকতার পরিবর্তন না হয়, তাহলে এ সংঙ্কটগুলো থেকে যাবে, আমাদের মধ্যে হতাশা বাসা বাঁধবে। আমরা যে যেখানে আছি নিজের কাজটা ঠিকমতো করে তবেই অন্যের সমালোচনা করি।’
শনিবার (১৮ অক্টোবর) সিলেট শহরে জেলা প্রশাসকের কনফারেন্স রুমে আয়োজিত ‘সিলেট বিভাগের বর্তমান শিক্ষা ও কর্মসংস্থান পরিস্থিতি’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সিলেট জেলা প্রশাসন ও জালালাবাদ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক মো: সারওয়ার আলমের সভাপতিত্বে সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিদ্যুৎ বিভাগের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. সৈয়দ মাসুম আহমেদ চৌধুরী, বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জালালাবাদ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু নাসের খান।
রাষ্ট্রদূত মুশফিক তার বক্তব্যে আরো বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা যারা বিভিন্ন দায়িত্বে আছেন তাদের মনে রাখা উচিত ট্যাক্সের টাকায় আপনাদের বেতন-ভাতা নিশ্চিত হয়, ভালো গাড়িতে চড়েন। এ জবাবদিহিতাটুকু থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে আমরা মনিবের আসনে নই, সেবকের দায়িত্বে।’
বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রশাসনের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা পরিহারের আহ্বান জানিয়ে রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘কর্তৃত্বপরায়ণতা যেন আমাদের গ্রাস না করে, পারস্পরিক সমঝোতা এবং সম্মানের একটি পরিবেশ যেন তৈরি হয়। এ জিনিসটা আমাদের সমাজে খুব অভাব। এক শ্রেণী মনে করে আমি উপরতলার মানুষ, আর অন্যরা মনে করে আমার জন্মই হয়েছে যেন মানুষকে সালাম দেয়ার জন্য— এ ব্যবধান ও দ্বিধার জায়গা ভেঙে দিতে হবে।’
সিলেটে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবি নিয়ে চলমান আন্দোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বেশ কিছুদিন যাবত সিলেটের কিছু বঞ্চনার কথা শুনছিলাম দেশের বাইরে বসে। আমার কর্মস্থল এখন দেশের বাইরে। ঢাকায় ফেরার পরই আমি এ বিষয় নিয়ে কয়েকজন উপদেষ্টার সাথে কথা বলেছি। সবাই এটার সমাধান নিয়ে চেষ্টা করছেন। যোগাযোগ উপদেষ্টা আশ্বস্ত করেছেন, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক উন্নয়নে তদারকি জোরদার করা হয়েছে। রেলে নতুন বগির অর্ডার করা হয়েছে, পাওয়া মাত্র সংযোগ করা হবে। বিমানের ভাড়া একটা নির্দিষ্ট হারের পর আর উঠবে না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় জানিয়েছে তারা স্থবির প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে উদ্যোগ নিয়েছেন। জনদুর্ভোগ লাঘবে টাকার যোগান দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রস্তুত।’
পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের দীর্ঘ সময়ের দুঃশাসন দেশের উন্নয়নে স্থবিরতা তৈরি করেছে উল্লেখ করে মুশফিক বলেন, ‘বাংলাদেশে একটা বড় ধরনের ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছরের একটা শাসনের অবসান ঘটেছে। এ ধরনের শাসনের পতনের পর যে পরিস্থিতির তৈরি হয় তাতে পুরো দেশকে একসাথে সেবা দেয়াটা সম্ভব হয়ে ওঠে না, এ সমস্ত ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতা ঘটে, ছন্দপতন ঘটে। বিষয়টা এমন না যে, সিলেটের ন্যায্য দাবির প্রতি কেউ অবজ্ঞা করছে বা মনোযোগ দিচ্ছে না। আমি এটা বিশ্বাস করতে চাই না। যথাযথ যোগাযোগ ও সমন্বয়ের মাধ্যমে সমস্যাগুলোর সমাধান করা সম্ভব। প্রত্যেককে নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে একটা দীর্ঘদিনের অভ্যাস হলো নিজের দায়িত্ব পালন না করে অপরের ওপর দোষ চাপাই, আমরা বলতে দেখি— উনি এটা করেনি, সেটা করেনি। সমাজে ও রাষ্ট্রে এরকম দায় চাপানোর একটা অভ্যাস দেখা যায়। অথচ নিজেকে প্রশ্ন করতে চাই না, আমি আমার কাজটা সঠিকভাবে পালন করছি কী-না?’
সমাজের প্রথাগত বাধা ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়ে এ রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘এ সমাজের কিছু প্রথাগত বাধা রয়েছে যেগুলো অন্যরা অনেক আগেই অতিক্রম করেছে কিন্তু আমরা এখনো সেখানে পড়ে রয়েছি। আমরা যদি এটা অতিক্রম করতে না পারি, আমাদের মধ্যে যদি ভ্রাতৃত্ব যদি না গড়ে ওঠে তাহলে পরিবর্তন হবে না। সমাজব্যবস্থার একটা পরিবর্তন দরকার।’
রাষ্ট্রের দায়িত্বকে সেবা করার সুযোগ হিসেবে দেখতে সরকারি কর্মকর্তাদের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উদাহরণ হিসেবে বলি, আমাকে কেউ টার্গেট ঠিক করে দেয়নি। কিন্তু আমি নিজ থেকে মেক্সিকোসহ ল্যাটিন অ্যামেরিকায় কিভাবে বাংলাদেশের পণ্য বিক্রি বাড়ানো যায় তা নিয়ে কাজ করছি। সেখানে এক বিলিয়ন ডলারের বাজার তৈরি করা সম্ভব।’
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করে ড. সৈয়দ মাসুম বলেন, ‘সিলেট বিভাগে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৩০ শতাংশ। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো সুনামগঞ্জ জেলায় এ সংখ্যা ৩৪.২৪ শতাংশ।’
বন্যায় ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বাধাগ্রস্ত হয় বলে জানান তিনি।
প্রবন্ধে বলা হয়, সিলেট বিভাগে গণিত, বিজ্ঞান ও ইংরেজিতে দক্ষ শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। আর এ ঘাটতির রেশ দেখা গেছে এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফলে। সরকারি স্কুলগুলোতে ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত হচ্ছে ১:১৮৫, অন্যদিক বেসরকারি স্কুলগুলোতে এটার অনুপাত আরো কম।
হাওর ও চা বাগানের এলাকাগুলোতে দরিদ্র লোকের বসবাস বেশি বলে প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়।
জালালাবাদ অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আবু নাসের খান বলেন, ‘সিলেট একসময় সারাদেশে শিক্ষার রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। দুঃখের বিষয় হচ্ছে এ অঞ্চলের বুদ্ধিভিত্তিক নেতৃত্ব কমে যাচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উন্নতি ঘটাতে হলে শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ ও বিশ্লেষণী দক্ষতার বিকাশ ঘটাতে হবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মো: জাবের, বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সচিব আব্দুর রহমান তরফদার, জাতীয় বেতন কমিশনের সচিব ফরহাদ সিদ্দিকী ও সিলেট বিভাগের কমিশনার খান মো: রেজাউন নবী প্রমুখ।



