সিলেট বিভাগের সীমান্ত এলাকায় একের পর এক হত্যাকাণ্ডে রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে সীমান্ত জনপদ। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) এবং তাদের সহযোগী খাসিয়া নাগরিকদের গুলিতে গত নয় মাসে অন্তত ছয়জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। প্রতি বছর বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের সম্মেলনে সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিক হত্যার সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি।
সর্বশেষ গত ২৫ থেকে ২৮ আগস্ট ঢাকায় অনুষ্ঠিত বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ের ৫৬তম সম্মেলনে ভারতীয় পক্ষ সীমান্তে হত্যা বন্ধের আশ্বাস দেয়। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির একদিন পরই সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে এক বাংলাদেশী নাগরিক বিএসএফের গুলিতে নিহত হন, যা সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সিলেট জেলার কানাইঘাট সীমান্তে একজন, মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া সীমান্তে দু’জন, হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট সীমান্তে একজন এবং সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার ও বিশ্বম্ভরপুর সীমান্তে দু’জন বাংলাদেশী বিএসএফের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন।
তথ্য অনুযায়ী, ২৬ জানুয়ারি মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের দশটেকি (নতুন বস্তি) এওলাছড়া সীমান্তে আহাদ আলী নামের এক বাংলাদেশীকে ভারতীয় নাগরিক হায়দার আলী ও তার সহযোগীরা পিটিয়ে হত্যা করে। ঘটনাটি আন্তর্জাতিক সীমান্ত রেখার মাত্র ৫ গজ ভেতরে সংঘটিত হয়। পরে তার লাশ সীমান্তে ফেলে পালিয়ে যায় অভিযুক্তরা।
৩১ মে একই উপজেলার শরীফপুর ইউনিয়নের দত্তগ্রাম সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন প্রদীপ বৈদ্য (২২)। তিনি দত্তগ্রামের বাসিন্দা শৈলেন্দ্র বৈদ্যর ছেলে। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের বিপরীতে অবস্থিত এই সীমান্তে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তার লাশ বিজিবির কাছে হস্তান্তর করা হয়।
২৯ আগস্ট সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার ডোনা সীমান্তে ১৩৩৯ নম্বর পিলারের কাছে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন আব্দুর রহমান (৪০)। তিনি আটগ্রাম বড়চাতল (বাকুরি) গ্রামের বাসিন্দা। পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে তার লাশও হস্তান্তর করা হয়।
৮ জানুয়ারি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মাছিমপুর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন সাইদুল ইসলাম (২৩)। তিনি গামাইতলা গ্রামের জয়নাল আবেদীনের ছেলে। গরু আনতে গিয়ে নো ম্যানস ল্যান্ডের কাছাকাছি পৌঁছালে বিএসএফ গুলি চালায়। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
১১ জুলাই একই জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার বাগানবাড়ি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন শফিকুল ইসলাম (৪৫)। তিনি লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের ভাঙ্গাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনিও গরু আনতে গিয়ে সীমান্তে প্রাণ হারান।
৬ জানুয়ারি হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলার বড় কেয়ারা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন জহুর আলী (৫৫)। তিনি পশ্চিম ডুলনা গ্রামের বাসিন্দা। তার লাশ ত্রিপুরা রাজ্যের খোয়াই মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যায় বিএসএফ। দুই দিন পর পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে লাশ হস্তান্তর করা হয়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে বিজিবি সিলেট সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সাইফুল ইসলাম চৌধুরীর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
বিজিবি সূত্র জানায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর সীমান্তে তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। তবে চোরাকারবারি ও মাদক পাচারকারীদের দৌরাত্ম এখনো থামেনি। বিজিবি বাংলাদেশী নাগরিকদের আন্তর্জাতিক সীমান্তরেখা মেনে চলার অনুরোধ জানিয়েছে।
বিজিবির কর্মকর্তারা জানান, সীমান্তে কোনো হত্যাকাণ্ডই গ্রহণযোগ্য নয়। এ বিষয়ে বিএসএফকে নিয়মিতভাবে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়। সীমান্তে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখতে দুই দেশের যৌথ উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন তারা।