মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি

দগ্ধ শামীমের শেষ কথা : হাসপাতাল এত দূরে কেন মা

সোমবার উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন জুলেখার আদরের ছোট সন্তান আব্দুল্লাহ শামীম (১৪)। মঙ্গলবার সকালে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ডিএম খালি মাঝিকান্দি এলাকার বাবার কবরের পাশেই শামীমকে দাফন করা হয়েছে।

নয়া দিগন্ত অনলাইন

Location :

Shariatpur
আব্দুল্লাহ শামীম
আব্দুল্লাহ শামীম

মাত্র আট মাস আগে সৌদি আরবে কর্মরত অবস্থায় মারা যান স্বামী আবুল কালাম মাঝি। ছেলেমেয়েদের বুকে ছড়িয়ে ধরে সেই শোক কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করছিলেন জুলেখা বেগম। কিন্তু তার আগেই ছেলে হারানোর শোক তার বুকে পাথরের মত চেপে বসল। সোমবার উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন জুলেখার আদরের ছোট সন্তান আব্দুল্লাহ শামীম (১৪)। মঙ্গলবার সকালে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার ডিএম খালি মাঝিকান্দি এলাকার বাবার কবরের পাশেই শামীমকে দাফন করা হয়েছে।

এ সময় আহাজারি করতে করতে পুত্রহারা জুলেখা বেগম বলছিলেন, “আমার বাবা বলছিল, মা, হাসপাতাল এতো দূরে কেন? কাছাকাছি হাসপাতাল হতে পারে না। আমাকে তোমরা চিকিৎসা করাতে বিদেশে নিয়ে যাও। আমার বাবা বাঁচতে চাইছিল। কেন আমার বাবা এভাবে চলে গেল?”

আবুল কালাম মাঝি ও জুলেখা বেগম দম্পতির তিন মেয়ে আর দুই ছেলের মধ্যে আব্দুল্লাহ শামীম সবার ছোট। ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছামীমের শিক্ষাজীবন শুরু হয়েছিল মাদরাসায়। পরে তাকে উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। শামীমের স্বপ্ন ছিল সে চিকিৎসক হবে। এর মধ্যে ডিসেম্বরে সৌদি আরবে মারা যান বাবা আবুল কালাম মাঝি। সংসারে ছন্দপতন ঘটলেও জুলেখা আর অন্য ভাই-বোনেরা মিলে শামীমকে পরম মমতায় আগলে রেখেছিলেন। জুলেখা পরিবারের সবাইকে নিয়ে উত্তরার দিয়াবাড়ীর খাল পাড়ে বসবাস করতেন। সেখান থেকে শামীমের স্কুল কাছেই ছিল।

পরিবার জানায়, প্রতিদিনের মত সোমবারও সহপাঠীদের সাথে শ্রেণিকক্ষে ক্লাস করছিল শামীম। টিফিনের তখন ১০ মিনিট বাকি। এর মধ্যে বিকট শব্দে বিদ্যালয়ের একটি ভবনে বিধ্বস্ত হয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান। সেই সময় গুরুতর আহত হয় শামীম। সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে উদ্ধার করে স্বজনদের খবর দেয়। তখন তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়। অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে ভর্তি করা হয় বার্ন ইউনিটে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত ১১টার দিকে মারা যায় শামীম।

শামীমের মৃত্যুর খবর তার গ্রামে পৌঁছালে এলাকাজুড়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। মঙ্গলবার সকালে লাশ গ্রামের বাড়ি ডিএম খালি মাঝিকান্দি এলাকায় নিয়ে আসা হয়। সকাল ৯টায় চরভয়রা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে তার নামাজে জানাজা হয়। শামীমের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্বজন ও এলাকাবাসী। ছেলের মৃত্যুতে কিছুক্ষণ পর পর মূর্ছা যাচ্ছেন মা জুলেখা বেগমও। তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা কেউ খুঁজে পাচ্ছে না।

শামীমের সাথেই বড় হয়েছে তার মামাতো ভাই আব্দুল্লাহ হুসাইন। গ্রামে এলে দুজন একোথে সময় কাটাত। এমনকি ঢাকায় গেলে আব্দুল্লাহকেও বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখাতো শামীম। খেলার সাথীকে হারিয়ে কান্না থামছে না আব্দুল্লাহর।

ভাগ্নেকে ভীষণ ভালোবাসতেন মামা সাইফুল ইসলাম। ছোট ভাগ্নের এমন করুণ মৃত্যু যেন কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তিনি। সাইফুল ইসলাম বলছিলেন, “ছোটবেলা থেকেই ভীষণ মেধাবী ছিল আমার ভাগ্নে। ওর স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে চিকিৎসক হবে। বাবার মৃত্যুর পর ওকে সবাই আগলে রেখেছিলাম। আজ ও আমাদের ছেড়ে বাবার কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় গেল। ওর চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।”

ভেদরগঞ্জ সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও ভারপ্রাপ্ত ইউএনও মোহাম্মদ মোজাহেরুল হক বলেন, “বিমান দুর্ঘটনার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। আজ রাষ্ট্রীয় শোক পালন করছি। আমরা নিহতের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করেছি। শোকসস্তপ্ত পরিবারের পাশে আমরা সব সময় থাকব।”