আজ পহেলা অগ্রহায়ণ, বাঙালীর প্রাচীনতম ঐতিহ্যের নবান্ন উৎসব। কৃষিনির্ভর মানিকগঞ্জে হেমন্তের আগমনী সুরে চারদিকে এখন ধান কাটার ধুম। মাঠে পাকা সোনালি ধানের শীষে নবান্নের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে কৃষক-কৃষাণীদের মুখে।
এবারের মৌসুমে ফলন ভালো হওয়ায় চাষিদের ঘরে উঠছে নতুন ধান, বাড়ির উঠানজুড়ে সাজানো হচ্ছে মাড়াই– শুকানোর ব্যস্ততা। এ নতুন ধান শুকানোর পর দু’একদিনের মধ্যেই চলবে পিঠা-পুলির-ক্ষিরের আমেজ।
শনিবার ঢাকা আরিচা মহাসড়ক সংলগ্ন মানিকগঞ্জ সদরের মুলজান- বাগজান, ঘিওরের বালিয়াখোড়া, কাউটিয়া, কোশুন্ডা, শিবালয়ের মহাদেবপুর, ফলসাটিয়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়— মাঠভর্তি সোনালি ধান কেটে বাড়ি ফিরছেন কৃষক।
মেঠোপথের পাশে খোলা মাঠে নারী-পুরুষ ধান মাড়াই ও শুকানোর কাজে ব্যস্ত। আশপাশের মাঠে রঙিন প্রজাপতি, শালিক-কবুতর আর নানা পাখির ওড়াউড়ি; আকাশে ঝলমলে রোদ— সব মিলিয়ে হেমন্তের চেনা নবান্ন উৎসব।
কৃষকরা জানায়, চলছে আমন ও বোরো ধান কাটা-মাড়াই। এবার বর্ষার পানি কম থাকায় অনেক জমিতে আমনের ফলন আশানুরূপ হয়নি। তাই অধিক ফলনের আশায় অনেকে ইরি-বোরো চাষ বাড়িয়েছেন।
মুলজান গ্রামের কৃষক আব্দুর রশিদ বলেন, ‘৪০ শতাংশ জমিতে আমন করেছি। বর্ষার পানি কম থাকায় ফলন কিছুটা কম হয়েছে। কাটা শেষ, মাঠের পাশেই এখন চলছে মাড়াই। নবান্নের আমেজ ধরে রাখতে আর বাড়ির সবাই পিঠে পুলির তৈরির জন্যই আমি প্রতিবছর আমন ধানের আবাদ করি।’
রাথুরা গ্রামের কৃষক কবির খান বলেন, ‘বর্ষায় পানি না থাকায় আমনের ফলন কম। তাই ৬০ শতাংশ জমিতে বোরো রোপন করেছি। প্রায় ৪৫ মণ ধান পাবো। একই জমিতে দুইবার বোরোর ভালো ফলন পেয়ে আমরা খুশি। অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটার কৃষকের মজাই আলাদা।’
ঘিওরের রামেশ্বরপট্টি গ্রামের কৃষাণী তাসলিমা বেগম বলেন, ‘পরিবারের সবাই মিলে নতুন ধান ঘরে তুলছি। এখন শুকিয়ে চাল গুঁড়ো করবো। একটু একটু শীতও পড়েছে। দিন ১৫ পর মেয়ে-জামাতা, আত্নীয়-স্বজনদের দাওয়াত দিয়ে নতুন চালের পিঠা খাওয়াবো।’
প্রাকৃতিক কৃষি কেন্দ্রের পরিচালক দেলোয়ার জাহান বলেন, ‘হেমন্ত এলে ফসল তোলার মাধ্যমে সমৃদ্ধির দ্বার খুলে যায় কৃষকদের। তবে কৃষকের সার্থকতা তখনই যখন তারা ফসলের ন্যায্যমূল্য পায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘জমকালো দেশীয় আদি ঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গে পালিত হবে নবান্ন উৎসব। এবার উৎসবে স্থানীয় কৃষক-কৃষাণী ছাড়াও দশের বিভিন্ন জেলার কয়েক শতাধিক বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষজন যোগ দেবেন। থাকবে ধান কাটা, পিঠে পুলি, লোকজ নানা আচার-অনুষ্ঠান।’
বালিয়াখোড়া ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল খান বলেন, ‘ফলন ভালো হওয়ায় কৃষকের আনন্দও বেশি। অনেক বাড়িতে ইতোমধ্যে নতুন চালের পিঠা-পায়েসের আয়োজন শুরু হয়েছে। এ ঐতিহ্য দীর্ঘদিনের।’
জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো: নজরুল ইসলাম বলেন, ‘জেলায় পুরোদমে আমন ও বোরো ধান কাটা হচ্ছে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সরকারের কাছে দাবি জানাই।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তহমিনা খাতুন বলেন, ‘উপজেলায় এ বছর উফশী, হাইব্রিড ও স্থানীয় জাতের আমন ধানের আবাদ হয়েছে দুই হাজার ৩৫০ হেক্টর জমিতে। বোরো ধানের আবাদ হয়েছে নয় হাজার ১২০ হেক্টর জমিতে। নতুন জাত— বোরো ৮৮, ৮৯, ৯২ ও ১০০ —চাষ করায় শস্যের নিবিড়তা ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। আশা করছি, কৃষকেরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাবেন। নবান্নে বাঙালীর উৎসবের আমেজ। কৃষকদের মাঝে পূর্ণতার হাসি।’



