সিলেটের ঐতিহ্যবাহী কিনব্রিজটি শেষ পর্যন্ত হকারমুক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) জেলা প্রশাসক মো: সারওয়ার আলমের নেতৃত্বে কিনব্রিজে অভিযান চালিয়ে হকারমুক্ত করা হয়। এরপর থেকে কিনব্রিজে হকার বসলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের হুশিয়ারী দেয়া হয়।
এদিকে যানজন নিরসনে নগরীর ফুটপাত দখলমুক্ত করতে অ্যাকশনে নেমেছেন সিলেটের নবাগত জেলা প্রশাসক মো: সারওয়ার আলম। হকার উচ্ছেদ নয় বরং পুনর্বাসনের জন্য নির্মিত লালদিঘীরপারস্থ অস্থায়ী হকার মার্কেট দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কার করে সকল হকারকে সেখানে স্থানান্তরের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।
এ লক্ষে সিলেট সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন প্রথমবারের মতো যৌথভাবে ১৫ দিনের অ্যাকশন প্ল্যান হাতে নিয়েছে। এর অংশ হিসেবে প্রথম দিনেই ঐতিহ্যের প্রতীক কীন ব্রীজ হকারমুক্ত করা হয়েছে।
শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সরকারি ছুটির দিনে সড়ক থেকে হকারদের সরিয়ে পুনঃস্থাপনের কার্যক্রম শুরু করেছে সিলেট সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন। এ সময় সকাল থেকে প্রশাসনের সাথে ছিলেন সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় কিনব্রিজ দিয়ে যানবাহন চলাচল দীর্ঘদিন ধরেই বন্ধ রয়েছে। শুধু মোটরসাইকেল পারাপার চলছিল। এই সুযোগে ক্ষুদ্র ও ভাসমান ব্যবসায়ীরা ব্রিজটি দখল করে সেখানে দেদারসে ব্যবসা চালিয়ে আসছিলেন। এ নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিকবার সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। সর্বশেষ নবাগত জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম সিলেটে যোগদানের পর কিনব্রিজ হকার মুক্ত করার ঘোষণা দেন। এর প্রেক্ষিতে শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলা প্রশাসনের অভিযানে তাদের উচ্ছেদ করা হয়।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজা-ই রাফিন সরকার ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা। অভিযানের সময় হকাররা দ্রুত তাদের মালামাল সরিয়ে নেন।
সিসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রেজা-ই রাফিন সরকার জানান, হকারদের জন্য লালদিঘীরপাড় হকার্স মার্কেট প্রস্তুত রয়েছে। ঘাটতি অংশ দ্রুত ঠিক করা হবে। সবাইকে সেখানে বসতে হবে।
অন্যদিকে সিলেট জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার মো: পারভেজ বলেন, দুপুরের পর জেলা প্রশাসক সারোয়ার আলম কীন ব্রীজ পরিদর্শন করেন এবং হকারদের ব্রিজ বা রাজপথ দখলের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নেন। তিনি আরো জানান, লালদিঘীরপার হকার্স মার্কেট সম্পূর্ণ প্রস্তুত হতে এক সপ্তাহ সময় লাগবে। এসময় পর্যন্ত হকাররা ফুটপাতে বসতে পারবেন, তবে রাজপথে নামলেই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পরে সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীও সিসিক কর্মকর্তাদের নিয়ে কীন ব্রিজ পরিদর্শন করেন।
সম্প্রতি সিলেটের ঐতিহ্যের প্রতীক কীন ব্রীজ রীতিমতো বাজারে পরিণত হয়েছিল। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সেখানে মাছ, তরিতরকারি, কাপড়চোপড়, ঘড়ি, টুথপেস্ট, টুথব্রাশ, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও মসলাসহ নানা সামগ্রী বিক্রি করতেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা।
এরপর সিলেট নগরীর হকার নির্ধরিত স্থানে পুনঃস্থাপন নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন সিলেটের জেলা প্রশাসক মো. সারওয়ার আলম। তিনি বলেন, সিলেট নগরীর হকারদের উচ্ছেদ করা হরা হবে না। তাদের সিটি করপোরেশন নির্ধারিত স্থানে পুনঃস্থাপন করা হবে। এজন্য সিটি করপোরেশন ও জেলা প্রশাসন যৌথভাবে ১৫দিনের অ্যাকশন প্লান হাতে নেয়া হয়েছে। ১৫দিনের মধ্যে একটি সমন্বিত পরিকল্পনার মাধ্যমে হকার পুনর্বাসনের টেকসই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হবে।
জানা গেছে, সিলেট অঞ্চলের প্রথম সেতুর নাম কিনব্রিজ। সুরমা নদীর সিলেট নগরীর অংশে লোহার কাঠামোয় তৈরি এ কিনব্রিজ। ২০১৯ সালে ঐতিহ্যের এই সেতুটিকে সংরক্ষণ করতে এই সেতু দিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত অনুসারে ওই বছরের ৩১ আগস্ট মধ্য রাতে কিনব্রিজের উভয় প্রবেশপথে লোহার বেষ্টনী লাগিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেতুর সামনে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ লিখা সাইনবোর্ড টানানো হয়। শুধুমাত্র পথচারীরা সেতুটি ব্যবহার করার সুযোগ পান।
তবে কিনব্রিজ দিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়ার পর সেতুর দক্ষিণ পাড়ের বাসিন্দারা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তাদের যাতায়াত সুবিধার জন্য এ সেতু দিয়ে যান চলাচল অব্যাহত রাখার দাবি জানান। কিছুদিন পর কিনব্রিজের উভয় প্রবেশপথে লাগানো লোহার বেষ্টনী ভেঙে রিকশা চলাচল শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে প্রায় পুরো বেষ্টনীই গায়েব হয়ে যায়।
এরপর ২০২৩ সালের সংস্কারের পর সেতুটিতে যান চলাচল বন্ধ রেখে শুধু পায়ে হাঁটার জন্য উন্মুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে পরে মোটর সাইকেল চলাচলেরও সুযোগ দেয়া হয়।
সিলেট নগরীর বুক চিঁরে যাওয়া সুরমা নদীর উত্তর ও দক্ষিণ পারের বাসিন্দাদের যোগাযোগ সুগম করতে ১৯৩৩ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয় কিনব্রিজের। ১৯৩৬ সালে সেতুটি চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। লোহা দিয়ে তৈরি এর আকৃতি অনেকটা ধনুকের মতো, যার দৈর্ঘ্য ১ হাজার ১৫০ ফুট এবং প্রস্থ ১৮ ফুট। আসাম প্রদেশের তৎকালীন গভর্নর মাইকেল কিনের নামে সেতুর নামকরণ হয় কিনব্রিজ। ধীরে ধীরে সিলেটের পরিচিতির অংশ হয়ে ওঠে সেতুটি। বর্তমান পর্যটন নগরী সিলেটে পর্যটকদের প্রিয় একটি স্থান হলো এই কিনব্রিজ। এই ব্রিজের পাশে দাঁড়িয়ে একটি ছবি তুলেই পর্যটকরা সামাজিক যোগযোগমাধ্যমে জানান দেন তারা সিলেটে এসেছেন।



