মাছের প্রজনন বাঁচাতে হাওরে নিয়ন্ত্রিত ট্যুরিজম জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফরিদা আখতার।
রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর) সকালে ময়মনসিংহে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) অডিটোরিয়ামে ‘বার্ষিক গবেষণা অগ্রগতি (২০২৪-২৫) পর্যালোচনা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন (২০২৫-২৬)’ শীর্ষক এক কর্মশালার উদ্বোধনের সময় বক্তৃতায় তিনি একথা বলেন।
ফরিদা আখতার বলেন, ‘জমি ভরাট হচ্ছে, হাওরে ট্যুরিজম হচ্ছে, কিন্তু মাছের ক্ষতি নিয়ে কেউ আলোচনা করছে না। মাছের প্রজনন মৌসুমে নিয়ন্ত্রিত ট্যুরিজমের নীতিমালা করা প্রয়োজন। হাওরের জমিতে ব্যবহৃত কীটনাশক মাছের জন্য হুমকি। কৃষিতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রভাব মাছের বাস্তুতন্ত্রে কিভাবে পড়ছে তা নিয়েও গবেষণা হয়নি। বিএফআরআইকে এসব বিষয়ে সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।’
তিনি আরো বলেন, ‘একসময় মুক্ত জলাশয়ের মাছ উৎপাদন ছিল ৬০ শতাংশ, আর বদ্ধ জলাশয়ের ৪০ শতাংশ। বর্তমানে চিত্র উল্টো হয়ে গেছে। আমরা চাই না মুক্ত জলাশয়ের মাছ কমে যাক। উভয় ক্ষেত্রেই উৎপাদন বজায় রাখা জরুরি।’
অবৈধ জাল ব্যবহারের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘আমাদের শুধু বদ্ধ জলাশয়ের মাছ দিয়ে হবে না, মুক্ত জলাশয়ের মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সমুদ্রের অতি আহরণের কারণে মাছ কমছে। আমাদের নিয়ন্ত্রিত উপায়ে আহরণ করতে হবে, নইলে ভবিষ্যৎ নষ্ট হবে।’
কর্মশালায় সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের চেয়ারম্যান ফারাহ শাম্মী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. মো: রফিকুল ইসলাম সরদার এবং মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. মো: আবদুর রউফ। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিএফআরআইয়ের মহাপরিচালক ড. অনুরাধা ভদ্র।
সচিব আবু তাহের মোহাম্মদ জাকের বলেন, ‘মৎস্য উন্নয়ন ও গবেষণার সাথে জড়িত বিজ্ঞানীদের যথাযথ সম্মান দিতে পে-কমিশনের কাছে তাদের বেতন কাঠামো বৃদ্ধির সুপারিশ করা হবে। আমাদের অনেক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী বেকার অবস্থায় আছে, অথচ এ প্রতিষ্ঠানে আমরা শূন্যপদ খালি রেখেই বসে আছি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না করা অত্যন্ত দুঃখজনক।’
তিনি আরো বলেন, ‘নতুন ও উন্নত জাতের মাছের প্রজনন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন আর্থসামাজিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, নদীগুলোতে দূষণ বাড়ছে। যার ফলে মৎস্যসম্পদ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে। পাশাপাশি সমুদ্র থেকে মাছ আহরণে প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।’
অনুষ্ঠানের শুরুতে বিএফআরআইয়ের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোহাম্মদ আশরাফুল আলম গত এক বছরের গবেষণা অগ্রগতি উপস্থাপন করেন। তিনি জানান, ইনস্টিটিউটের গবেষণায় সুবর্ণ রুই, পুষ্টি সমৃদ্ধ ছোট মাছ চাষ প্রযুক্তি, দেশীয় প্রজাতির প্রজনন ও সংরক্ষণে সফলতা, রাঁজপুটি উদ্ভাবন, বটম ক্লিন পদ্ধতিতে দেশীয় মাছ চাষ, ডিএনএ বারকোডিংয়ের মাধ্যমে ৭৫টি প্রজাতি শনাক্তকরণ, মাছের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন, ছোট চিংড়ির চাষ ব্যবস্থাপনা, কাপ্তাই লেকে কার্পজাতীয় নতুন প্রজাতি শনাক্তকরণ, ইলিশ সম্পদ ব্যবস্থাপনা, হাওর সম্পদ সংরক্ষণ, উন্মুক্ত জলাশয়ে খাঁচায় মাছ চাষ, কুঁচিয়া ও কৈ মাছের চাষ, সিড উইড প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং সুনীল অর্থনীতিতে মৎস্য খাতের সম্ভাবনা নিয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য এসেছে।
দিনব্যাপী আয়োজনে টেকনিক্যাল সেশনে বিএফআরআইয়ের পাঁচটি কেন্দ্র ও পাঁচটি উপকেন্দ্র থেকে আগত বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা ৫০টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।
কর্মশালা শুরুর আগে সকাল ৮টার দিকে সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের বিএফআরআইয়ের গবেষণা মাঠ পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি জায়ান্ট পাঙ্গাসের কৃত্রিম প্রজনন ও চাষ পদ্ধতি উন্নয়ন প্রকল্প, মহাশোল মাছের ব্রুড উন্নয়ন ও প্রজনন গবেষণা, দেশীয় মাছের সংরক্ষণ, গুড়া চিংড়ি চাষ, কৈ মাছের প্রজনন ও চাষ প্রযুক্তি, কুঁচিয়া মাছের ব্রিডিং এবং বটম ক্লিন ইউনিট প্রকল্পসহ চলমান গবেষণা কার্যক্রম ঘুরে দেখেন।