মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার পশ্চিম কুমুল্লি গ্রামের সমাজসেবক ছোরহাব উদ্দিন (৭০) আজ নদীভাঙনের ভয়াল হুমকির মুখে। নিজের ভিটেমাটি হারানোর শঙ্কায় অসহায় দিন কাটাচ্ছেন।
সামাজিক কবরস্থানের জন্য জমি দান করেছেন, দু’টি মসজিদের জন্য জমি দিয়েছেন, অপর একটি মসজিদ নির্মাণের জন্য দিয়েছেন নিজের এক বিঘা জমি বিক্রির সমস্ত অর্থ। ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে তার অবদান স্থানীয়দের কাছে এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
স্থানীয়রা তাকে ডাকেন দানশীল ছোরহাব উদ্দিন।
কখনো ব্যক্তিস্বার্থে সম্পদ ব্যবহার করেননি ছোরহাব উদ্দিন। যা কিছু ছিল, তা তিনি অকাতরে ব্যয় করেছেন সমাজকল্যাণে। অথচ জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এই দানশীল মানুষটিই মাথা গোঁজার ঠাঁই হারানোর দ্বারপ্রান্তে।
সরজমিন দেখা যায়, তার মায়ের পাকা কবর ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। চোখে রাজ্যের সমস্ত শূণ্যতা। মাত্র ১০ হাত দূরেই ভয়াল কালীগঙ্গার স্রোতের হুংকার। ৬০ শতাংশ বসতভিটার মধ্যে ইতোমধ্যে ৪০ শতাংশ ভেঙে গিয়েছে কালীগঙ্গায়। বাকি অংশও সরাসরি ভাঙনের হুমকিতে। তার বাড়ির উপর দিয়েই ভাঙনকবলিত প্রতিবেশীরা ঘর-দোর সরিয়ে নিচ্ছে।
নিজের অসহায়তার কথা বলতে গিয়ে ছোরহাব উদ্দিনের কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, ‘সারা জীবন যতটুকু পেরেছি, মানুষের জন্য করেছি, তা সবাই জানে। এখন যদি নদীভাঙনে নিজের ঘরবাড়িই হারাই, তবে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব? বাবার কবর গেছে নদীতে, এখন কষ্ট লাগছে- মায়ের কবরের শেষ চিহ্নও চোখের সামনে নদীগর্ভে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে।’
নদী পাড়ে ভাঙন আতঙ্কগ্রস্তরা বলছেন, ছোরহাব উদ্দিন শুধু সমাজসেবক নন, ছিলেন এলাকার প্রবীণ মাতব্বর এবং সবার আস্থার একজন ন্যায় বিচারক। অসহায় মানুষের চিকিৎসা-খাদ্যে সহযোগিতা, এলাকার দরিদ্র মেয়েদের বিয়েতে সহায়তা, এমনকি নিজের বাড়ির ওপর দিয়ে রাস্তা উন্মুক্ত করে দেয়ার মতো উদারতা দেখিয়েছেন তিনি। অথচ আজ তিনি নিজেই ভিটেমাটি হারানোর শঙ্কায় দিন পার করছেন। শুধু ছোরহাব উদ্দিন নন, তার বাড়ি ও আশপাশের আরো অন্তত ২০টি পরিবার ভাঙনের নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। এছাড়াও পশ্চিম কুমুল্লি, জাবরা কাউটিয়া ও পেঁচারকান্দা গ্রামের আরও অর্ধশত পরিবারও একই হুমকিতে।
আবেগাপ্লুত ছোরহাব উদ্দিনের ছেলে সজল বলেন, ‘আমার বাবা সারা জীবন সমাজের জন্য যা করেছেন, আমরা চোখের সামনে তা দেখেছি। অথচ আজ আমাদের নিজের ঘরবাড়িই নদীতে হারানোর উপক্রম। এটি শুধু আমাদের পরিবারের নয়, পুরো গ্রামের কষ্ট।’
প্রতিবেশী মো: রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ছোরহাব উদ্দিন শুধু সমাজসেবকই নন, তিনি আমাদের এলাকার প্রবীণ মাতব্বর ও ভালো বিচারক। সারাজীবন দান করেছেন- দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বিয়েশাদীতে সহায়তা, নিজের বাড়ির ওপর দিয়ে রাস্তা খুলে দিয়েছেন, অসহায় মানুষকে খাদ্য, চিকিৎসা ও নগদ সহায়তা দিয়েছেন। আজ এমন একজন মানুষ ভিটেমাটি হারানোর শঙ্কায়- এটি আমাদের জন্য ভীষণ বেদনাদায়ক।’
স্থানীয় বালিয়াখোড়া ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল খান বলেন, ‘এক সময়ের অবস্থাসম্পন্ন ছোরহাব উদ্দিনের মতো সমাজসেবক আজ ভাঙনের হুমকিতে, এটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আমরা ইতোমধ্যে উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি। তারা জানিয়েছেন, দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিবেন।’
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান জানান, যমুনা, ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদীর কয়েকটি অংশে ভাঙন রোধে প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। কালীগঙ্গার ভাঙনের জরিপ ও প্রাথমিক পরিকল্পনা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রেরণ করা হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত জিও ব্যাগ ফেলার মাধ্যমে ভাঙন প্রতিরোধে কাজ শুরু হবে।
এলাকাবাসীর জোর দাবি, অবিলম্বে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে নদীভাঙন রোধ করতে হবে এবং সমাজসেবক ছোরহাব উদ্দিনসহ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিতে হবে।