জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেছেন, ‘যদি এনসিপিকে শাপলা প্রতীক পেতে রাজপথে রাজনৈতিকভাবে কর্মসূচিতে যেতে হয়, তাহলে এনসিপি ‘স্বেচ্ছাচারী’ নির্বাচন কমিশনের পুনর্গঠনের আন্দোলনেও যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আইনগতভাবে শাপলা প্রতীক পেতে এনসিপির কোনো বাধা নেই। আমরা সকল আইনজ্ঞ, আইনপ্রণেতা, আইন বিশেষজ্ঞ এবং যারা আইন নিয়ে কথা বলেন, সবার সাথে কথা বলেছি, তারাও বলেছে- শাপলা দলীয় প্রতীক হিসেবে পেতে আইনগত কোনো বাধা নেই। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন স্বেচ্ছাচারিতা করছে এবং পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। আমরা অভ্যুত্থান পরবর্তী নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে এ ধরনের স্বেচ্ছাচারী আচরণ কখনো প্রত্যাশা করি না।’
গতকাল রোববার দুপুরে কিশোরগঞ্জ জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে এনসিপির জেলা ও উপজেলা সমন্বয় সভার মধ্যাহ্ন বিরতিতে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। বেলা ১১টায় এই সমন্বয় সভা শুরু হয়। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সারজিস আলম।
সারজিস বলেন, নির্বাচন কমিশন যদি অভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতায় এখনো তাদের স্বাধীনতা স্বকীয়তার প্রদর্শন না করতে পারে, তাহলে আগামীর নির্বাচনে আমরা তাদের প্রতি আস্থা রাখতে পারব না। ওই নির্বাচন কমিশনের দ্বারা যদি নির্বাচন হয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে কাজ ও কথার মাধ্যমে তাদেরকে নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে হবে।’
এনসিপির এই নেতা আরো বলেন, আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় আধিপত্যবাদ, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন, প্রয়োজনীয় মৌলিক সংস্কার এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে এককভাবে বিএনপি ও জামায়াত তাদের জায়গা থেকে নেতৃত্ব দিতে পারবে না। সেই জায়গায় তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব আবশ্যক; এনসিপির প্রতিনিধিত্ব আবশ্যক। আমরা মনে করি, আগামীর সংসদে তরুণদের ওই কণ্ঠস্বর জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। কারণ এই তরুণরাই ভারতীয় আধিপত্যবাদসহ বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট কাঠামোর বিরুদ্ধে আপসহীনভাবে রাজপথে লড়াই করেছিল।’
তিনি বলেন, ‘যখন রাজনৈতিক দলগুলোর উপরে মানুষের আস্থা অনেকটাই কমে গিয়েছিল এবং রাজনৈতিক দলগুলোর অস্তিত্ব একটা গুরুত্বপূর্ণ অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন বাংলাদেশের তরুণরা হাল ধরে এবং তরুণদের নেতৃত্বে একটা গণঅভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। এই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ বাস্তবতায় আমরা মনে করি গণতান্ত্রিক উত্তরণের যে প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়ায় এনসিপিসহ তরুণদের অংশগ্রহণ অতীব জরুরি। সেজন্য জুলাই সনদ নিয়ে আমরা আমাদের আপসহীন অবস্থান ব্যক্ত করেছি। অন্যান্য রাজনৈতিক দল যখন জুলাই সনদের প্রশ্নে নিশ্চয়তার যেটি প্রয়োজন ছিল সেই নিশ্চয়তার প্রসেসিং কিভাবে হবে, কবে হবে, সেটি ঠিক না করে শুধুমাত্র নির্বাচনমুখী আচরণ করে জুলাই সনদে স্বাক্ষর করল, তখন এনসিপি তাদের জায়গা থেকে মেরুদণ্ড সোজা করে নিশ্চয়তা চেয়েছে এবং জুলাই সনদে স্বাক্ষর করেনি।
জুলাই সনদ স্বাক্ষর নিয়ে সারজিস আলম আরো বলেন, যেদিন জুলাই সনদ বাস্তবায়নের নিশ্চয়তা দেয়া হবে, যেদিন সেই আদেশ জারি করা হবে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে এবং গণভোটে যদি জুলাইয়ের পক্ষে রায় আসে, তখন কোনো নোট অফ ডিসেন্টকে বিবেচনা করা হবে না, এই নিশ্চয়তা যখন আসবে তখন বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে আমরা জুলাই সনদে স্বাক্ষর করব। এনসিপি কোনো নিশ্চয়তা ছাড়া শুধু একটি কাগজে স্বাক্ষর করে জনগণের সাথে প্রতারণা করতে পারে না।’
নির্বাচনী জোট প্রসঙ্গে সারজিস আলম বলেন, এনসিপি আগামী নির্বাচনে শুধু কয়েকটি সীটের জন্য সংসদে যাওয়ার জন্য জোট করার জন্য কাজ করছে না। এনসিপি মনে করে, কোনো রাজনৈতিক দল যদি তাদের জায়গা থেকে জুলাই সনদের প্রত্যেকটি সংস্কার বাস্তবায়নে কমিটেড থাকে, বিচারিক প্রক্রিয়াকে ধারাবাহিকভাবে সামনে এগিয়ে নিয়ে সম্পূর্ণ করতে কমিটেড থাকে, ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে কমিটেড থাকে, আওয়ামী লীগ-জাতীয় পার্টিসহ ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কমিটেড থাকে, তাহলে ওই নির্বাচনে তাদের সাথে এলায়েন্স হতে পারি।’
প্রশাসন সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সারজিস আলম বলেন, ‘প্রশাসনে ঘুরেফিরে এখন পর্যন্ত যারা আছেন, তারা কেউ বিএনপিপন্থী আচরণ করেন, কেউ জামায়াতপন্থী আচরণ করেন, কারো পূর্বের আওয়ামী লীগের সাথে সম্পৃক্ততা ছিলো বলে ওই পন্থী আচরণ করেন। বিশেষ করে যারা ইউএনও আছেন, ওসি আছেন, তাদের আচরণটায় দলীয় আচরণ আসে। তারা বিভিন্ন দলীয় ইউএনও, দলীয় ওসি হয়ে ওঠতে চান। আমাদের জেলা প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার যারা আছেন, তারাও দলীয় জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার হয়ে ওঠতে চান। মন্ত্রণালয়ে কিছু সচিব আছেন, তারা দলীয় সচিব হয়ে ওঠতে চান। আমরা তাদেরকে স্পষ্ট করে বলি, এবার তারা অনেকটাই পার পেয়ে গিয়েছেন। কারণ এই অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের মানুষের আগে ছিল না এই পর্যায়ে। কিন্তু আগামীতে যদি তারা এই আচরণ বহাল রাখেন আর আমাদেরকে আবার এই রকম একটা বড় ঘটনার দিকে যেতে হয়, তখন কেউ আর বিন্দুমাত্র আশ্রয় পাবেন না, প্রশ্রয় পাবেন না। আমি অনুরোধ করবো তাদেরকে তারা যেন দলীয় প্রশাসন না হয়ে ওঠেন। আমরা চাই তারা বাংলাদেশের প্রশাসন হয়ে ওঠুক। বাংলাদেশের মানুষের হয়ে ওঠুক।
আরেক প্রশ্নের জবাবে সারজিস আলম বলেন, জুলাইয়ে যারা রাজপথের যোদ্ধা ছিল, শহীদ পরিবারের যারা, তাদেরকে এখন হুমকি দেয়া হচ্ছে। হুমকি দেয় কারা- যারা ২৪ এ আমাদের এই সহযোদ্ধাদের উপর হামলা করেছিলো, গুলি ছুঁড়েছিল। তারা এখন টাকার বিনিময়ে, বিভিন্ন নেগোসিয়েশনের বিনিময়ে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে পেছন থেকে আঁতাত করে, ক্ষমতায় থাকা প্রশাসনের কিংবা বিচার বিভাগে থাকা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে আঁতাত করে, তারা জামিন নিয়ে যাচ্ছে। হাইকোর্টে একটার পর একটা জামিন হয়ে যায়। কারণ ওই হাইকোর্টে ওই আওয়ামী লীগের দোসর অনেক বিচারক এখনো বসে আছে। বাংলাদেশর প্রত্যেকটা গুরুত্বপূর্ণ আদালতে আইনজীবী থেকে শুরু করে বিচারক পর্যায়ে এমন অনেকে আছে, যারা সুযোগ পেলেই এইসব গুরুত্বপূর্ণ হত্যা মামলার আসামিদেরকে তারা জামিন দিয়ে দেয়। টাকার বিনিময়ে হচ্ছে, পলিটিক্যাল নেগোসিয়শনের বিনিময়ে হচ্ছে। আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, তারা যদি এই বিষয়ে কঠোর না হন, তাহলে আগামীর বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যাবে না। নির্বাচন একটা অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে যাবে। তবে এই কথাটা দিয়ে আপনারা এই দিকে টানবেন না যে নির্বাচনে অনিশ্চয়তার কথা বলেছে তার মানে এনসিপি বলে নির্বাচন পেছাতে চায় না। এটা হচ্ছে বর্তমান বাস্তবতা।
তিনি আরো বলেন, যদি আমার একজন আহত যোদ্ধা, আমার একজন শহীদ পরিবারের উপরে এই ধরনের আক্রমণ হয় এবং অনিরাপত্তায় ভোগে, তাহলে আগামীতে পরিস্থিতি কিছুটা অস্থিতিশীল হবে। সেই জায়গায় সংশ্লিষ্ট সবাইকে আহ্বান করবো, আপনারা আপনাদের জায়গায় কঠোর হোন। আমরা বিভিন্ন ধরনের গুপ্ত মিছিল দেখি। আমরা আপনাদেরকে অনুরোধ করবো, আপনাদের জায়গা থেকে গুপ্ত আচরণ থেকে যদি বাংলাদেশের মানুষকে আপনারা আপনাদের জায়গা থেকে মনে করেন যে আপনারা বাংলাদেশের অংশ সামনে আসেন। বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের সহযোদ্ধারা আপনাদের মোকাবেলা করবে। আমরা অনুরোধ করবো প্রশাসনকে, গোয়েন্দা বিভাগকে তাদের সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে যেন এটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। আমরা একসাথে জুলাই অভ্যুত্থানবিরোধী যাদের অবস্থান ছিলো বাংলাদেশের সরকার, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সে থাকতে হবে।’
এনসিপি কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সদস্যসচিব আহনাফ সাঈদ খানের সভাপতিত্বে এর আগে সমন্বয় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সারজিস আলম। এতে বিশেষ অতিথি ছিলেন এনসিপি ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল্লাহ হায়দার, কেন্দ্রীয় সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) খায়রুল কবির ও সাঈদ উজ্জ্বল এবং কেন্দ্রীয় সদস্য দিদার শাহ। সমন্বয় সভায় এনসিপির জেলা ও উপজেলা সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।



