আগামী সাত দিনের মধ্যে রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের পুনর্বহাল করা না হলে ১৩ জুন থেকে নগরে ভবনের সামনে জনতার মঞ্চ বসিয়ে লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা। এসময় তিনি বর্তমান প্রশাসকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ তুলে তাকে অপসারণের দাবি করেন। তবে বর্তমান প্রশাসক বিভাগীয় কমিশনার তার বিরুদ্ধে করা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
বুধবার (২৮ মে) রংপুর নগরবাসীর ব্যানারে নাগরিক সেবা নিশ্চিত এবং হয়রানি বন্ধে মেয়র ও কাউন্সিলরদের পুনর্বহালের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল শেষে সমাবেশে একথা বলেন তিনি।
এর আগে নগরীর শাপলা চত্বর থেকে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। মিছিলটি গ্রান্ড হোটেল মোড়, জাহাজ কোম্পানি মোড়, পায়রা চত্বর, কৈলাশরঞ্জন স্কুল মোড়, টাউন হল ঘুরে নগর ভবনের প্রধান ফটক বন্ধ করে দিয়ে সমাবেশ করে।
বিক্ষোভে সংহতি প্রকাশ করে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্যে এস এম ইয়াসির, যুগ্ম-মহাসচিব আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে নেতাকর্মীরা অংশ নেন।
এছাড়া বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠন, পেশাজীবী সংগঠনসহ নগরীর বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ অংশ নেন। তারা ‘আবু সাঈদের রংপুরে বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘মেয়র কাউন্সিলরদের পুনবর্হাল করো করতে হবে’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন। প্রচন্ড গরমেও মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে ওঠে নগরী। বিক্ষোভ ও সমাবেশে প্রায় দেড় ঘণ্টা নগরীতে তীব্র যানজটের তৈরি হয়।
নগর ভবনের প্রধান ফটকের সামনে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ পরিচালনা করেন সাবেক প্যানেল মেয়র মাহমুদুর রহমান টিটু। এসময় বক্তব্য রাখেন বিভিন্ন পেশাজীবী ও ব্যবসায়ী সংগঠন এবং মেয়র ও কাউন্সিলররা।
সমাবেশে যোগ দিয়ে সাবেক মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, ‘স্থানীয় সরকারের ২০০৯ এর আইন বলবৎ থাকলেও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেই আইনকে কলাপস করে দিয়ে ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে সিটি পরিষদ বাতিল করেছেন। বাংলাদেশে যত পট পরিবর্তন হয়েছে কোনো সরকারই স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় হাত দেয় নাই। কারণ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে জনগণের সরাসরি সম্পৃক্ততা আছে।’
বক্তব্যে সাবেক মেয়র মোস্তফার অভিযোগ করে বলেন, ‘এই সিটি করপোরেশনে এমন একটা দুর্নীতিবাজ বিভাগীয় কমিশনারকে দায়িত্ব দিয়েছে যিনি টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝেন না। প্রত্যেকটা ফাইলে এক পারসেন্ট টাকা আগে গুনে নেবে তালিকা দেবে তারপর সই করবে। রংপুরের মানুষের রক্ত চুষে এই ধরণের বিভাগীয় কমিশনারকে দায়িত্ব দিয়ে রংপুর সিটিবাসীর প্রতি একটা স্টিম রোলার চালানো হচ্ছে। এর আমরা তীব্র প্রতিবাদ করছি। অবিলম্বে তাকে অপসারণ করে অন্য একজন যোগ্য মানুষকে আপাতত দায়িত্ব দিয়ে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার অনুরোধ জানাচ্ছি।’
মোস্তফা বলেন, ‘প্রশাসক এবং কয়েকজন কর্মকর্তা সিটি করপোরেশনের কার্যক্রম স্থবির করে দিয়েছেন। এটা লাগবে ওটা লাগবে বলে নগরবাসীকে বিরক্ত করেছেন। উৎস কর আদায় করবে ভ্যাট অফিস। রংপুর সিটির কর্মকর্তাদের দিয়ে সেই ট্যাক্স আদায় করে কেন ভ্যাট অফিসকে দেব। রংপুরের মানুষ আর ঢাকার মানুষের মধ্যে অনেক পার্থক্য আছে । রংপুরের মানুষের আয় আর ঢাকার মানুষের আয় আসমান জমিন তফাৎ। পানের দোকানী ৬০০ টাকা দিয়ে ট্রেড লাইসেন্স করে। এখন তাকে উৎস কর দিতে হবে দুই টাকা। সেই টাকা সে কোথায় পাবে। এই অত্যাচার কেন। রংপুরবাসীর সাথে এই অত্যাচার আমরা মানবো না।’
মোস্তফা বলেন, ‘রংপুর সিটি করপোরেশন একটা সাজানো বাগান ছিল। সেই বাগানটাকে গুটি কয়েক কর্মচারী-কর্মকর্তা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছে। এক কোটি টাকা ব্যায়ে যন্ত্রপাতি ক্রয় করে দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু মাসে মাত্র কুড়ি লিটার তেলের কারণে অকেজো হয়ে পড়ে আছে। এই হল এখনকার অর্থব সিটি প্রশাসক। এই প্রশাসন থাকলে শুধু হয়তো ইট আর পাথর থাকবে আর কোনো কিছু থাকবে না ভাই আমার। রংপুরের সকল দলমত মানুষকে নিয়ে এই অথর্ব প্রশাসককে বিদায় জানাতে হবে।’
মোস্তফা বলেন, ‘দিনের ভোট রাতে করেছে। কারা করেছে। এই বিভাগীয় কমিশনাররা করেছে। এই ডিসি এসপি, ইউএনও ওসিরা করেছে। কিন্তু আপনারা জনগণের ওপর দোষ দেন। আমি প্রধান উপদেষ্টা ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টাকে বলতে চাই আপনারা সাত দিনের মধ্যে রংপুর সিটি পরিষদকে আগের মতো কার্যকর করবেন। আর যদি সেটা না করেন তাহলে ঈদের পরে আগামী ১২ অথবা ১৩ জুন থেকে লাগাত কর্মসূচি হবে এই সিটি গেটের সামনে জনতার মঞ্চ হবে। যতক্ষণ পর্যন্ত দাবি আদায় না হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত লাগাতর কর্মসূচি ঘোষণা করা হলো। সেটি অব্যাহত থাকবে।’
মোস্তফা বলেন, ‘আপনারা সবাই প্রস্তুত থাকবেন। দাবি আদায় করতে গেলে আঙ্গুল বাকা করতে হবে। সোজা আঙ্গুলে যদি ঘি না ওঠে আঙ্গুল বাকা করতে হবে। মব ভাইলেন্স আপনারা জানেন। শাহবাগ বন্ধ করা আপনারা জানেন। রংপুরের মানুষ কি করতে পারে আর কি করতে পারে না সেটা আপনাদের পূর্বসুরিদের কাছে জেনে নিন। আবার জ্বলে ওঠবে রংপুর। আবার জ্বলে ওঠবে রংপুরের সাধারণ আপামর জনতা। দলমত নির্বিশেষে সকলে মিলে রংপুরকে অচল করে দেয়ার আমরা ঘোষণা দিচ্ছি। ইনশআল্লাহ বিজয় আমাদের হবে।’
তবে সাবেক মেয়র মোস্তফার অভিযোগ অস্বীকার করে সিটি প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনার শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘ ওয়ান পারসেট কেন এক পয়সাও আমি কারো কাছে গ্রহণ করি না। এসবের সাথে আমার দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। আমি যখন সিটির দায়িত্ব পাই তখন আর্থিক অবস্থাটাই ছিল। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর প্রতিমাসে দুই কোটি টাকা আয় বেড়েছে। এখন স্থিতি ১৪ কোটি টাকা। মূলত এই জায়গাটা আমাদের নয় জনপ্রতিনিধির। আমরা চাই জনপ্রতিনিধি আসুক। এ ব্যপারে একটা সুরাহা হোক। আমার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ করা হচ্ছে তার সাথে আমার দূরতম কোনো সম্পর্ক নাই।‘
সমাবেশে মোস্তফা আরো বলেন, ‘আজকে একই দেশে কয় আইন ভাই? আজকে একটা দেশে কয়টা আইন। কিভাবে দেশ চলছে। আজকে চিটাগাংয়ের মেয়র ভোট বয়কট করেও তারা মেয়রগিড়ি করছে। ইশরাক সাহেবও চেষ্টা করছে। তাদের আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু রংপুর সিটি করপোরেশনের বৈধ ভোটে নির্বাচিত মেয়র-কাউন্সিলরদের একই কলমের খোচায় বাতিল করে দিলেন। এটা রংপুরের মানুষ মানে না। ‘
মোস্তফা বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌর পরিষদ, জেলা পরিষদ এবং সিটি পরিষদ নিয়ে স্থানীয় সরকার চলে। নৌকা লাঙ্গল ধানের শীষ নিয়ে ভোট করে ইউনিয়ন পরিষদে ভোট করে তারা বহাল তবিয়তে আছে। অন্য কোন জায়গায় কি হবে। জানি না। আজকে মিসকল দেয়া হলো। এই সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। এই সরকার স্থানীয় সরকারসহ দেশ পরিচালনায় ব্যর্থ। তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে খেলছে।’
মোস্তফা বলেন, ‘সারা দেশের মধ্যে একমাত্র জনপ্রতিনিধি যিনি রংপুর সিটি করপোরেশনে মেয়র ও পরিষদ এই আন্দোলনে সমর্থন দিয়ে সব ধরণের সহযোগিতা করেছি। কিন্তু আমরাই বৈষম্যের শিকার। এথন দেশ চলছে মব ভাইলেন্সে। মব করতে পারলেই জয়। কথায় আছে আইন খালি, গাইনের ওপর এক নোকতা। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। কিন্তু আর থাকতে পারছি না। একটা মেয়রকে অপসারণ করা হলে একটা কাউন্সিলরকে অপসারণ করা হলে ৯০ দিনের মধ্যে ওই শুন্য আসনে নির্বাচন হবে। আজকে নয় মাস অতিক্রম হলো। কোনো নির্বাচন হচ্ছে না। ‘
সমাবেশে সংহতি প্রকাশ করে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মচারী সমিতির পক্ষে বক্তব্যে আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমি দুঃখ নিয়ে বলছি। ৫ আগস্টের পর যখন ট্রাফিক ব্যবস্থা খারাপ হলো। তখন মেয়র মোস্তফার ডাকে সাড়া দিয়ে আমরা রাস্তায় ট্রাফিকিং করেছি। সেই নির্বাচিত মেয়র ও কাউন্সিলরদের অপসারণ করা হলো। এখন সিটি করপোরেশন স্থবির হয়ে পড়েছে। অবিলম্বে তাদের পুনবর্হাল করতে হবে।‘
বিক্ষোভ ও সমাবেশ অংশ নিয়ে সুপার মার্কেট ব্যাবসায়ী সমিতির সভাপতি জাবেদ হোসেন জুয়েল বলেন, ‘চট্রগ্রামে মামলা করে বিজয়ী হয়ে সিটি চালাচ্ছে। আর আমাদের লাভ লাখ জনতার ভোটে নির্বাচিত মেয়র মোস্তফাকে অপসারণ করা হয়েছে। তাকে দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। বর্তমান প্রশাসকও দায়িত্ব পালন করতে পারছে না। এই বৈষম্য কেন। আমরা রংপুরের সকল ব্যবসায়ী ও আপমার জনগণ যেকোনমূল্যে রংপুর সিটির মেয়র ও কাউন্সিলরদেরকে স্বপদে দেখতে চাই।’
সমাবেশে মহানগর দোকান কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি জিহদ হোসেন বলেন, ‘ আমাদের নির্বাচিত মেয়র মোস্তফা যখন ক্ষমতায় ছিলেন তখন আমরা শ্রমিক শ্রেণি তার কাছে কিছু না কিছু উপকার পেয়েছি। তিনি বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা করে অর্থ দিয়ে নিজে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। মাঠে থেকে সবার সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচার পতন করেছেন। কিন্তু তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা দ্রুত তাকেসহ কাউন্সিলরদের স্বপদে বহাল চাই। তা না হলে রংপুরের গোটা শ্রমিক সমাজ মাঠে নেমে সব কিছু অচল করে দিবে। ‘
সমাবেশে মহিলা সাবেক কাউন্সিলর ফেরদৌসি বেগম বলেন, ‘ আকাশ মেঘ করলো না হঠাৎ বৃষ্টি। সেটাই করলো আমাদেরকে এই সরকার। বুঝলামই না আমরা ইটের গুতা খাইলাম। নাকি বাঁশের গুতা খাইলাম। চারটাং মিটিং। রাত ১২টায় আমাদেরকে করে দিলো আউট। এটা কি কোনো সংবিধান, এটা কি কোনো আইন। আমি চারবার কাউন্সিলর হয়েছি। এমন ঘটনা আমি আমার বয়সে দেখি নাই। আমাদের তো একটা গঠনতন্ত্র আছে। সেটাও বাদ। একজন এরকরম করতে করেত বিতাড়িত হয়ে গেলো। আর এখন যারা এসেছে তারাও একই ঘটনা শুরু করেছে। তাহলে বুঝবো কেমন করে দেশে গণতন্ত্র আছে। বুঝবো কিভাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হবে। বুঝবো কেমন করে সত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। বুঝবো কেমন করে যে আমি সৎ আমার একটা মূল্যয়ন আছে। আমরা মাঠে ছাত্রদের খাবার দিয়েছি। ছাতা দিয়েছি। তাদের পাশে থেকেছি। কিন্তু এটা কি হলো যে, একজন চুরি করলো সবাই চোর হলো। আমরা আমাদের পুনর্বহাল চাই।’
সমাবেশে সাবেক কাউন্সিলর মকবুল হোসেন বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধীদের এই সরকার। কিন্তু সিটি করপোরেশনের মেয়র কাউন্সিলরদের বরখাস্ত করলো। ইউনিয়ন পরিষদেরগুলো রয়ে গেলো। আবার চট্রগামে মেয়র এখনও বহাল তবিয়তে। একই সরকার । ঘটনা দুইধরণের। এটা মানা যায় না। আজ রংপুর সিটি করপোরেশন বাসির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। মানুষি স্থবির হয়ে পড়েছে। কোন সেবা পাচ্ছে না। দ্রুত মেয়র ও কাউন্সিলরদের বহাল করে গেজেট প্রকাশ করতে হবে। তা নাহলে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবে নগরবাসী।