জয়পুরহাটের কালাইয়ে বসেছে ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা

এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ওই এলাকার মেয়ে-জামাই মেলা থেকে সেরা মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে যান। তাই এ মেলাকে জামাই মেলাও বলা হয়ে থাকে।

ওমর আলী বাবু, জয়পুরহাট
ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা
ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা |নয়া দিগন্ত

জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় প্রতি বছরের মতো এবারো বাঙালির ঐতিহ্য নবান্ন উৎসব উপলক্ষে মাছের মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ মেলায় কোটি টাকার অধিক মাছ বিক্রি হবে বলে ধারণা করছে ব্যবসায়ীরা।

এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ওই এলাকার মেয়ে-জামাই মেলা থেকে সেরা মাছ কিনে শ্বশুরবাড়িতে যান। তাই এ মেলাকে জামাই মেলাও বলা হয়ে থাকে।

কালাই-বগুড়া মহাসড়কের পাশে কালাই পৌরসভার পাঁচশিরা বাজারে বসেছে এ মাছের মেলা। মেলায় সুন্দর করে সাজানো কাতলা, রুই, মৃগেল, চিতল, গ্রাসকার্প, কার্ফু, কালবাউশ, ব্রিগেড, সিলভার কার্পসহ বিভিন্ন জাতের মাছ নিয়ে বসেছে দোকানিরা।

তিন কেজি থেকে শুরু করে ১৮ কেজি ওজনের বড় মাছ পাওয়া যাচ্ছে মেলায়। মাছের আকার অনুযায়ী প্রতি কেজি মাছ দু’ শ’ থেকে ১২ শ’ টাকা কেজি বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতারাও ব্যাপক উৎসাহের সাথে মাছ কিনছেন। আবার দেখতে এসেছেন অনেকেই।

মেলায় জামাই-মেয়েদের মাছ কেনার প্রতিযোগিতা হয়। কোন জামাই কত বড় মাছ কিনলেন তার প্রতিযোগিতা চলে। এ দিকে নীরবে অংশগ্রহণ করেন শ্বশুরেরাও। মেলায় অংশ নেন উপজেলার মাত্রাই, উদয়পুর, পুনট, জিন্দারপুর, আহম্মোবাদ ইউনিয়ন ও কালাই পৌরসভার শতাধিক গ্রাম-মহল্লার মানুষেরা।

মেলায় আগত মাছ ব্যবসায়ী ও স্থানীয়রা জানান, পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রহায়ণ মাসের দ্বিতীয় দিনে এ মেলা বসে। নতুন ধান কাটার উৎসবে কৃষকদের প্রস্ততকৃত চালে প্রথম রান্না উপলক্ষে এ নবান্ন উৎসব পালিত হয়। এদিনে মেয়ে-জামাই ও আত্মীয়-স্বজনকে আমন্ত্রণ করেন কৃষকরা। যথারীতি অনুষ্ঠান পালন করতে জামাই-মেয়ে, মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি ও আত্মীয়-স্বজনরা আসেন বাড়িতে। পাড়া-মহল্লায় উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। পিঠা-পুলি, পায়েস, গুড় ও চিনির ক্ষীর সাথে খই ও মুড়ি খাওয়ার ধুম পড়ে যায়।

এলাকাবাসীরা জানান, ৫০ বছর ধরে ঐতিহ্যবাহী মেলাটি যেমন মাছের জন্য বিখ্যাত, তেমনি ওই এলাকায় ধান-আলুতেও ভরপুর থাকে। এ কারণে আশপাশের লোকজন মেলায় ছুটে আসে।

মাছ ব্যবসায়ীরা কয়েক দিন আগে থেকেই তাদের আড়ৎ ঘরে নানান জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করেন। মেলায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষরা উচ্চ মূল্যে এসব মাছ ক্রয় করেন। এ বছর তিন কেজি থেকে ৩৫ কেজি ওজনের মাছের সমাগম চোখে পড়েছে। আগের তুলনায় এ বছর মেলায় লোকজনের উপস্থিতিও ছিল বেশি।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার বেচা-কেনা কম। তারা লোকশানের সঙ্কায় রয়েছেন।

মেলায় এবার সর্বোচ্চ ৩৫ কেজি ওজনের একটি সিলভার কার্প মাছ বিক্রি হয়েছে ৪২ হাজার টাকায় এবং ১৯ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার টাকায়। মেলার আয়োজক না থাকলেও স্থানীয় মাছ ব্যবসায়ীরা প্রায় ১৫ দিন আগে থেকে মেলার জন্য প্রস্তুতি নেন। আশপাশ এলাকায় মাছ ব্যবসায়ীরাই মাইকে প্রচার করেন।

মাছ ব্যবসায়ী মজনু মিয়া জানান, ‘নানান জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। কাতলা, রুই, মৃগেল সাত শ’ থেকে দেড় হাজার টাকা কেজিতে এবং বাঘাআইর ও চিতল মাছ ১৩ শ’ থেকে দু’ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি আকারের মাছ ৩০০-৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।’

মাছ বিক্রেতা জামাল বলেন, ‘মেলাতে বড় পুকুর, দিঘি ও নদী থেকে নানান জাতের বড় বড় মাছ অনেক আগে থেকেই খোঁজ নিয়ে সংগ্রহ করা হয়।’

মাছ কিনতে আসা মেহেদী জানান, ‘এই নবান্নের মেলা আমাদের কাছে ঈদের চেয়েও বেশি আনন্দের। বাড়িতে মেয়ে-জামাই, ভাগ্নি জামাইকে দাওয়াত করা হয়েছে। এই মাছের মেলাকে কেন্দ্র করে বাড়িতে অনেক মেহমান এসেছে। এইজন্য আমরা খুব খুশি।’

মাছ কিনতে আসা জুয়েল হোসেন বলেন, ‘প্রতিবছর মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি ও স্বজনরা এই দিনের অপেক্ষায় চেয়ে থাকে। প্রায় পাঁচ হাজার টাকায় ১০ কেজি ওজনের একটি সিলভার কার্প মাছ কিনেছি। বাড়িতে গেলে নাতি-নাতনিরা খুব খুশি হবে।’

কালাই হাট ইজারাদার আব্দুল আলিম সরকার বলেন, ‘শুধু জয়পুরহাট নয়, বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যাপারীরা এ মেলায় মাছ এনে বিক্রি করেন।’

কালাই উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা তৌহিদা মোহতামিম জানান, নবান্ন উৎসব উপলক্ষ্যে কালাই উপজেলা পাঁচশিরা বাজারে মাছের মেলা আয়োজন করে থাকে। এটা শুধু মাছ কেনা-বেচা নয়, আনন্দ উৎসবও বটে। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির দেশীয় মাছ বিক্রি করা হয়।