জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে নিহত গাইবান্ধার সবুজের বাড়িতে শোকের মাতম

‘হামার একনা ব্যাটা (আমার একটা ছেলে)। তাই কিসোক বিদেশোত গ্যালো (সে কেন বিদেশ গেলো)। বিদেশোত না গ্যালে মরলো না হয়, তোমরা হামার ব্যাটাক আনি দেও (বিদেশ না গেলে মরত না, তোমরা আমার ছেলেকে এনে দাও)।’

সৈয়দ রোকনুজ্জামান, গাইবান্ধা

Location :

Palashbari
জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে নিহত গাইবান্ধার সবুজ
জাতিসঙ্ঘ শান্তি মিশনে নিহত গাইবান্ধার সবুজ |নয়া দিগন্ত

যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের আবেইতে অবস্থিত জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ঘাঁটিতে সন্ত্রাসী ড্রোন হামলায় নিহত মো: সবুজ মিয়ার গ্রামের বাড়ি গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে চলছে স্বজনদের শোকের মাতম।

নিহত সবুজ মিয়া শান্তিরক্ষা মিশনে লন্ড্রি কর্মচারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি উপজেলার মহদিপুর ইউনিয়নের ছোট ভগবানপুর গ্রামের মরহুম হাবিদুল ইসলামের ছেলে। গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ওই ছোট ভগবানপুর গ্রাম।

আজ রোববার (১৪ ডিসেম্বর) বিকেলে সবুজ মিয়ার গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, গ্রামজুড়ে শোকের মাতম। বাড়িতে আহাজারি চলছে। আত্মীয়-স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। তাদের সান্ত্বনা দিতে আশপাশের লোকজন ভিড় করছেন। স্ত্রী নুপুর আক্তার (২২) আহাজারি করছেন। বারবার লুটিয়ে পড়ছেন।

নুপুর আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন, ‘আমাদের নতুন সংসার। অনেক স্বপ্ন ছিল। সব স্বপ্ন ভেঙে গেল, এখন স্বামীকেই হারালাম। আমি টাকা চাইনা, আপনারা আমার স্বামীকে এনে দেন।’

এ সময় তার বৃদ্ধা মা ছকিনা বেগম (৬৮) কখনো কাঁদছেন, কখনো সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছেন। তিনি ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে নিজের ভাষায় বলছিলেন, ‘হামার একনা ব্যাটা (আমার একটা ছেলে)। তাই কিসোক বিদেশোত গ্যালো (সে কেন বিদেশ গেলো)। বিদেশোত না গ্যালে মরলো না হয়, তোমরা হামার ব্যাটাক আনি দেও (বিদেশ না গেলে মরত না, তোমরা আমার ছেলেকে এনে দাও)।’

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, এক ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবুজ মিয়া ছোট। একমাত্র বোন আরফিন বেগমের বিয়ে হয়েছে। তিনি ঢাকার একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন।

সবুজ ২০১০ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। দেড় বছর আগে নওগা জেলায় বিয়ে করেন তিনি। তাদের কোনো সন্তান নেই। গত ৭ নভেম্বর সবুজ মিয়া সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যান।

সবুজ মিয়ার চাচা শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় দেড়মাস আগে সবুজ বাড়িতে এসেছিল। সে বিদেশে যাওয়ার আগে বলেছিল, সুদানে শান্তিরক্ষা মিশনে গেলে অনেক টাকা ভাতা পাবে। সেই টাকা দিয়ে বাড়িতে অসমাপ্ত ঘর ঠিকঠাক করবে। বাড়ির জায়গায় বাড়ি থাকল, সে ফিরবে লাশ হয়ে। সবুজের লাশ যেন সরকার দ্রুত আমাদের কাছে পৌঁছে দেয়। এটাই আমাদের দাবি।’

পলাশবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সরোয়ারে আলম খান মোবাইলফোনে বলেন, ‘সবুজ মিয়ার গ্রামের বাড়িতে খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। তার লাশ আসতে সময় লাগবে ‘

এর আগে, শনিবার (১৩ ডিসেম্বর) সুদানের আবেই এলাকায় জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনের আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক ঘাঁটিতে স্থানীয় সময় আনুমানিক দুপুর ৩টা ৪০ মিনিট থেকে ৩টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী কর্তৃক ড্রোন হামলা চালায়। ওই হামলায় দায়িত্বরত ছয়জন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী শহীদ হন এবং আটজন আহত হন।

শহীদ শান্তিরক্ষীরা হলেন— কর্পোরাল মো: মাসুদ রানা, এএসসি (নাটোর), সৈনিক মো: মমিনুল ইসলাম, বীর (কুড়িগ্রাম), সৈনিক শামীম রেজা, বীর (রাজবাড়ি), সৈনিক শান্ত মন্ডল, বীর (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) ও লন্ড্রি কর্মচারী মো: সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা)।

আহত শান্তিরক্ষীরা হলেন— লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান, পিএসসি, অর্ডন্যান্স (কুষ্টিয়া), সার্জেন্ট মো: মোস্তাকিম হোসেন, বীর (দিনাজপুর), কর্পোরাল আফরোজা পারভিন ইতি, সিগনালস (ঢাকা), ল্যান্স কর্পোরাল মহিবুল ইসলাম, ইএমই (বরগুনা), সৈনিক মো: মেজবাউল কবির, বীর (কুড়িগ্রাম), সৈনিক মোসা: উম্মে হানি আক্তার, ইঞ্জিনিয়ার (রংপুর), সৈনিক চুমকি আক্তার, অর্ডন্যান্স (মানিকগঞ্জ), সৈনিক মো: মানাজির আহসান, বীর (নোয়াখালী)।