মাত্র ২০ দিনের ব্যবধানে চট্টগ্রাম বন্দরে আবারও প্রাণঘাতি ঘনচিনির (সোডিয়াম সাইক্লামেট) বিশাল চালান আটক করেছে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এবার আটক করা হয়েছে ৩৯ হাজার কেজি (৩৯ মেট্রিক টন) ঘনচিনি।
গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের অডিট, ইনভেস্টিগেশন ও রিসার্চ (এআইআর) টিম খালাসের শেষ মুহূর্তে পণ্য চালানটি আটক কওে বলে কাস্টমস সূত্র জানিয়েছে। নামে বেনামে ঘনচিনি বাংলাদেশে ঢুকাতে জনস্বাস্থ্য মারাত্মক হুমকিতে পড়ছে। কেউ কেউ সন্দেহ করছেণ অসাধু একটি গোষ্ঠী সাদা চিনিতে এই প্রাণঘাতি ঘনচিনির মিশ্রণ ঘটাচ্ছে কিনা?
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের উপ-কমিশনার (এআই্আর) মো: তারেক মাহমুদ নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, আটককৃত চালনের তথ্য পর্যালোচনায় জানা যায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান এস পি ট্রেডার্স, ২১৮ মিটফোর্ড রোড, বংশাল, ঢাকা বিগত ৪ অক্টোবর পলি এলুমিনিয়াম ক্লোরাইড ঘোষণায় চীন থেকে তিনটি কন্টেইনারে ৬৩ মেট্রিক টন পণ্য চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করে। চালানটি খালাসের জন্য আমদানিকারকের পক্ষে সি বার্ড করপোরেশন নামীয় সিঅ্যান্ডএফ অ্যাজেন্ট কর্তৃক বিল অব এন্ট্রি নং ১৮২৮২৭৮, তারিখ: ০৭.১০.২০২৫ দাখিল করা হয়।
পণ্যচালানটি খালাসের জন্য ট্রাকে লোড করার পর গোপন সংবাদের ভিত্তিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ উক্ত পণ্যের খালাস স্থগিত করে এবং গত ২৮ অক্টোবর সিঅ্যান্ডএফ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কায়িক পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষাকালে দুই ধরনের পণ্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায় যার নমুনা উত্তোলন সংগ্রহ করে চট্টগ্রাম কাস্টমসের ল্যাবে রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য প্রেরণ করা হয়। রাসায়নিক পরীক্ষার প্রতিবেদনে উক্ত দুই শ্রেণির পণ্যের মধ্যে একটিতে ২৪ মেট্রিক টন পলি অ্যালুমিনিয়াম ক্লোরাইড পাওয়া গেলেও বাকি ৩৯ মেট্রিক টন পণ্যকে ঘনচিনি (সোডিয়াম সাইক্লামেট) হিসেবে নিশ্চিত করা হয়েছে।
এই শুল্ক কর্মকর্তা জানান, ঘনচিনি আমদানি নিষিদ্ধ। কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষ অনুমতি নিয়ে শিল্পকারখানার জন্য আমদানি করা যায়। তবে তা খুবই নিয়ন্ত্রিত। সোডা অ্যাশ বেভারেজ জাতীয় ইন্ডাস্ট্রিতে ব্যবহার হয় এবং দেখতে অনেকটা ঘনচিনির কাছাকাছি। হয়তো সেই সুযোগটাই নেয়ার চেষ্টা করে অসাধু আমদানিকারকরা।
নিষিদ্ধ ঘনচিনি আমদানি করায় কাস্টমস আইন, ২০২৩ এর বিধান মোতাবেক পণ্যচালানটি চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃক আটক করা হয়েছে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন আছে।
ইতোপূর্বে গত ২১ অক্টোবরও সোডা অ্যাশ এর মিথ্যা ঘোষনা দিয়ে আনা ৩টি কনটেনারে মিলে ৬০ হাজার ৪৮০ কেজি মানুষের জীবননাশকারী ঘনচিনি। এর আগে ২০২২ সালের মে মাসেও চট্টগ্রাম বন্দরে আটক করা হয়েছিল ১৯ হাজার কেজি ঘনচিনির বড় একটি চালান। সেই চালানও এসেছিল সোডা অ্যাশের ঘোষণায়।
এই শুল্ক কর্মকর্তা জানান, ঘনচিনি একটি কৃত্রিম মিষ্টিকারক যা সাধারণ চিনির চেয়ে প্রায় ৩০ থেকে ৫০ গুণ বেশি মিষ্টি। বিভিন্ন ধরনের মিষ্টান্ন, বেকারি আইটেম, আইসক্রিম, বেভারেজ, জুস, চকোলেট, কনডেন্সড মিল্ক এবং শিশু খাদ্য তৈরিতে সাধারণ চিনির পরিবর্তে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী এই ক্ষতিকারক কৃত্রিম উপাদানটি ব্যবহার করে থাকে।
ঘনচিনি দিয়ে তৈরি খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ঘনচিনির দ্বারা প্রস্তুতকৃত খাদ্য ক্যান্সারসহ কিডনি ও লিভারের জটিল রোগের কারণ হতে পারে। ঘনচিনির অপব্যবহার রোধকল্পে সরকার পণ্যটিকে আমদানি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমদানি নীতি আদেশ ২০২১-২০২৪ এর আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যের তালিকায় ঘনচিনি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
অভিযোগ রয়েছে, এমনিতেই ঘনচিনি প্রাণঘাতি। এর ওপর অসাধু ব্যবসায়ীরা ঘনচিনির সাথে ম্যাগনেসিয়াম সালফেট নামীয় রাসায়নিক সার মিশিয়ে প্যাকেটজাত করে সস্তায় বিক্রি করে।
এছাড়া বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুস্টি বিভাগ কর্তৃক ২০১৯ সালে করা এক গবেষণা জরিপে বাজার থেকে ব্র্যান্ড-নন ব্র্যান্ড সাদা চিনির নমুনা সংগ্রহ করে সিঙ্গাপুরে পাঠায় সোডিয়াম সাইক্লামেটের উপস্থিতি নির্ধারণের জন্য।
রিপোর্টে সব নমুনায় অল্প পরিমাণে ঘন চিনির উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছিল। অথচ কোন মাত্রায় ঘন চিনির অস্থিত্ব থাকার সুযোগ নেই।
এদিকে উপর্যুপরি ঘনচিনির বড় চালান আটকের ঘটনায় নতুন করে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে ভিন্ন নামে প্রতিনিয়তই কি প্রাণঘাতি এই পন্য আমাদের দেশে ঢুকছে?



